বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান মন্তব্য করেছেন, ফ্যাসিস্টরা দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও দেশের রাজনীতি থেকে ‘ফ্যাসিজমের কালো ছায়া এখনো কাটেনি’। তিনি অভিযোগ করে বলেন, একদল অপকর্ম করে পালিয়েছে, আর আরেকদল সেই অপকর্মের দায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘একদল দখলদার হয়ে জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছে, আরেকদল বেপরোয়া দখলদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।’ শনিবার (৬ ডিসেম্বর) বিকেলে সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে ইসলামী ও সমমনা আট দলের বিভাগীয় সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। জামায়াত আমীর তাঁর বক্তব্যে আন্তর্জাতিক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ‘আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক’ দেশ পরিচালনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং জোটের বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
ফ্যাসিজমের কালো ছায়া ও অপকর্মের দায়
ডা. শফিকুর রহমান তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, একদল ফ্যাসিস্ট দেশ থেকে পালিয়ে গেলেও তাদের রেখে যাওয়া ফ্যাসিজমের অন্ধকার এখনও বিদ্যমান।
তাঁর অভিযোগ:
- অপকর্মের দায় গ্রহণ: তিনি বলেন, একদল অপকর্ম করে পালিয়েছে, আরেকদল সেই অপকর্মের দায় কাঁধে তুলে নিয়েছে। কেউ চাঁদাবাজি করে জনগণের ক্ষোভের কারণ হয়েছে, আবার কেউ আরও বেশি শক্তি নিয়ে একই কাজ করছে।
- দখলদারিত্বের প্রবণতা: জামায়াত আমীর বলেন, একদল দখলদার হয়ে জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছে, আরেকদল বেপরোয়া দখলদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।
- নির্যাতনের ধারাবাহিকতা: একসময় বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের, আলেম-ওলামাকে জেল, নির্যাতন, ফাঁসি ও দেশছাড়া করার যে প্রবণতা ছিলো, সেটি এখনো থামেনি।
তিনি আফসোস করে বলেন, স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হয়ে গেলেও বাংলাদেশের মানুষ সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি, কারণ দেশের ভেতরের ‘চিলগুলো’ জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে বিদেশে বেগমপাড়া গড়ে
অতীতের শিক্ষা ও নতুন রাজনীতির ব্যর্থতা
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, দফায় দফায় এত রক্ত, এত ত্যাগের পরে দেশবাসী রাজনীতিবিদদের কাছে প্রত্যাশা করেছিল যে, অতীতের অপকর্মের পরিণতি থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন রাজনীতি শুরু হবে। কিন্তু তিনি দুঃখের সঙ্গে দেখতে পাচ্ছেন, ‘একদল সেই পুরাতন ধারায় পড়ে রয়েছে।’
তিনি বলেন, এই দলটি কোনো সংস্কারে রাজি না, সনদ বাস্তবায়নে রাজি না। তারা গণভোটেও প্রথমে রাজি ছিলো না। তারপরও ধাক্কায় ধক্কায় গণভোট একদিনেই হতে হবে, তা তারা বাধ্য করেছে সরকারকে। এখন আবার কোথাও কোথাও ক্ষীণ সুর শোনা যাচ্ছে যে, যারা এতোদিন নির্বাচনের জন্য জনগণকে বেহুশ করে তুলেছিলো, এখন তারা ভিন্ন সুরে কথা বলতে শুরু করেছে। তিনি বলেন, এ লক্ষণ ভালো নয়।
নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র ও লালকার্ডের হুঁশিয়ারি
জামায়াত আমীর আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে, আগামী নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র হতে পারে। তিনি বলেন, জনগণ তাদেরকে (বিএনপিকে ঈঙ্গিত করে) আগামী নির্বাচনে লালকার্ড দেখানোর জন্য প্রস্তুত হয়ে গেছে।
তিনি হুঁশিয়ারি দেন:
“এই লালকার্ড দেখা থেকে বাঁচতে গিয়ে যদি কেউ আগামী নির্বাচনকে ভণ্ডুল করার চেষ্টা করে, আমরা মহান আল্লাহর ওপর ভরসা করে বলছি, তাদের সব ষড়যন্ত্র এ দেশের সংগ্রামী জনগণ ভণ্ডুল করে দেবে, ইংশাআল্লাহ।”
তিনি বলেন, কেউ যদি বাঁকা পথে প্রশাসনিক ক্যু’র মাধ্যমে নির্বাচনের ক্রেডিট হাইজ্যাক করার চিন্তা করে, তাদেরকে বলবো—সেই সূর্য ডুবে গেছে, এই সূর্য আর বাংলাদেশে উঠবে না। কালো সূর্য বাংলাদেশের মুখ দেখবে না, এখন নতুন সূর্যের উদয় হবে।
আন্তর্জাতিক শক্তিকে চ্যালেঞ্জ ও দাদাগিরি বরদাশত নয়
ডা. শফিকুর রহমান দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়ে তার কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কেউ কেউ জামায়াতকে অন্যদের রক্তচক্ষুর ভয় দেখান—অমুক শক্তি, তমুক শক্তি, অমুক দেশ, তমুক দেশ।
তবে তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দেন:
“ইসলামি এবং দেশপ্রেমিক নেতাকর্মীরা হাসি হাসি যেখানে ফাঁসি বরণ করতে পারে, মেহেরবানি করে তাদেরকে কোনো কিছুর ভয় দেখাবেন না। আমরা ভয় করি শুধু আল্লাহ তায়ালাকে। বাকি যাদের কথা বলেন, তাদেরকে আমরা কোনো পাত্তাই দিই না।”
তিনি বিশ্বের সব শান্তিকামী দেশকে সম্মান জানানোর কথা বললেও কঠোরভাবে বলেন, “কিন্তু কেউ যেন আমাদের ওপর কোনো দাদাগিরি করতে না আসে। আমরা আর কারও দাদাগিরি দেখতেও চাই না। বরদাশত করতেও রাজি নই। বাংলাদেশ চলবে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ মোতাবেক। এই দেশের জনগণের পছন্দের বাইরে কারো পছন্দ-অপছন্দের কথা আমরা শুনতে চাই না।”
জোটের বাইরে থাকা ইসলামী দলগুলোর প্রতি আহ্বান
ডা. শফিকুর রহমান জোটের বাইরে থাকা দু-একটি ইসলামী দলকে উদ্দেশ্য করে ঐক্যের আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি বন্ধুদেরকে অনুরোধ করব, সব জাল ছিন্ন করে আপনারা আপনাদের আঙিনায় চলে আসুন। এই আঙিনা আপনাদের আঙিনা। এখন যেখানে ঘোরাফেরা করছেন, এটা আপনাদের আঙিনা না। তাদের সঙ্গে আপনাদেরকে মানায় না। আপনারা বড় বেমানান হয়ে গেছেন। আপনারা ঘরের ছেলে ঘরে চলে আসুন। আমরা আপনাদেরকে বুকে জড়িয়ে কবুল করবো, অভিনন্দন জানাবো, ইংশাআল্লাহ।’
তিনি যারা অন্যদের তল্পিবাহক হবে, তাদের অতীত থেকে শিক্ষা নিতে বলেন। তাদের অবস্থা হয়েছে ‘অখাদ্য’ যারা পেটে আশ্রয় নিয়েছে—গিলতেও পারছে না, ফেলতেও পারছে না—এই পর্যায়ে এসে গেছে। তিনি তাদের দেশের আকাঙ্ক্ষাকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করতে বলেন।
বিভাগীয় সমাবেশে অন্যান্য বক্তা
সিলেটের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা আব্দুল বাছিত আজাদ এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ রেজাউল করিম (পীর সাহেব চরমোনাই), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির আমির মাওলানা সারওয়ার কামাল আজিজি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির মাওলানা হাবীবুল্লাহ মিয়াজী, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি রাশেদ প্রধান এবং বাংলাদেশ ডেভোলাপমেন্ট পার্টির (বিডিপি) সভাপতি অ্যাডভোকেট আনোয়ারুল হক চাঁন। এই সমাবেশটি ইসলামী ও সমমনা দলগুলোর মধ্যেকার রাজনৈতিক ঐক্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
এম আর এম – ২৫১৩, Signalbd.com



