বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবসময়ই স্বাধীনতা যুদ্ধ, রাজাকার-আলবদর ইস্যু এবং যুদ্ধাপরাধের প্রশ্ন অত্যন্ত সংবেদনশীল ও আলোচিত বিষয়। নির্বাচন সামনে এলে এই ইস্যুগুলো আরও বেশি আলোচনায় চলে আসে। ২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে রাজনৈতিক বক্তব্যের মাত্রাও তীব্র হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন বিতর্ক তৈরি করলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী এবং অভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতা মির্জা আব্বাস।
তিনি দাবি করেন, যারা ১৯৭১ সালে আলবদর ও রাজাকার নামে পরিচিত ছিল—আজ তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা যাচ্ছে সর্বত্র, এমনকি তারা ভোট চাইতেও মাঠে নেমেছে। পাশাপাশি তিনি আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করে বলেন, এসব লোকের সাথে নৈতিকভাবে দূরত্ব বজায় রাখার কথা বললেও বাস্তবে তাদের প্রতি সুযোগসন্ধানী আচরণই দলটির চরিত্রকে প্রকাশ করে।
বুধবার ঢাকায় মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধনে বক্তব্য
৩ ডিসেম্বর, বুধবার রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী বালুর মাঠে একটি বিনামূল্যের মেডিকেল ক্যাম্প উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত নেতাকর্মী এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষের সামনে তিনি এসব মন্তব্য করেন।
বিএনপির নেতাদের ঘিরে যখন সরকারের বিভিন্ন সমালোচনা এবং নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে বিতর্ক বেড়েই চলেছে, তখন এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন আলোচনা তৈরি করেছে।
ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ
নিজের বক্তব্যের শুরুতেই মির্জা আব্বাস অভিযোগ করেন, কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনী পরিবেশকে প্রভাবিত করতে ধর্মকে ব্যবহার করছে। তার ভাষায়—
“ধর্ম মানুষের আত্মিক বিষয়। কিন্তু আজকে দেখা যাচ্ছে, ভোট না দিলে জান্নাত-জাহান্নাম নিয়ে কথা বলা হচ্ছে। এমনকি কুপিয়ে মারার মতো হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এই ভয়-ভীতির রাজনীতি আমাদের সমাজে থাকা উচিত নয়।”
তিনি মনে করেন, নির্বাচনকে ঘিরে ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করার প্রবণতা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
এ ধরনের বক্তব্য মূলত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি পুরোনো ইস্যুর দিকে ইঙ্গিত করে—নির্বাচনে ধর্মের ভূমিকা, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন এবং ভোটারদের বিশ্বাসকে প্রভাবিত করা।
১৯৭১ সালের রাজাকার–আলবদর ইস্যুতে কঠোর অবস্থান
মির্জা আব্বাস বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী হিসেবে যাদের পরিচিতি ছিল—আজ তারাই আবার ভোট চাইছে, মানুষের সামনে বড় বড় কথা বলছে। তিনি বলেন—
“যারা স্বাধীনতার সময় দেশের জনগণকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল, যারা নারীদের ওপর নির্যাতনের পথ সুগম করেছিল—আজ তারা আবার ভোট চাইতে এসেছে। তাদের কি এই বাংলাদেশ চাওয়া ছিল?”
এই বক্তব্যে তিনি মূলত বর্তমান রাজনৈতিক অঙ্গনে কয়েকটি ধর্মভিত্তিক দলের সক্রিয়তা এবং তাদের নির্বাচনমুখী প্রচারণা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগকে ‘অসভ্য দল’ আখ্যা
তিনি বেশ কঠোর ভাষায় আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করে বলেন—
“আওয়ামী লীগ অসভ্য দল। তাদের সঙ্গে অসভ্যরাই বেশি মানায়। তারা সভ্যতা বোঝে না, শালীনতা বোঝে না। তারা ধর্মকে বিকৃত করে। আমরা তাদের মতো আচরণ করতে পারি না বলেই তারা বেশি চেঁচায়।”
একই সঙ্গে তিনি দাবি করেন—
“আওয়ামী লীগ মওদুদীবাদে বিশ্বাস করে, ইসলামের প্রকৃত চেতনাকে তারা মানে না। শুধু মুসলমানের লেবাস আছে।”
নেতা হিসেবে তার এই বক্তব্য নতুন মাত্রা যোগ করেছে রাজনৈতিক কথোপকথনে, বিশেষ করে যখন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনের মাঠে পরস্পরের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় সমালোচনা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজাকার ইস্যুর গুরুত্ব
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভিত্তি। বর্তমান ও অতীত সরকারগুলো—উভয় দলই মুক্তিযুদ্ধকে নিজেদের রাজনীতির কেন্দ্রীয় অংশ হিসেবে ব্যবহার করেছে। রাজাকার-আলবদরের ইস্যু শুধু রাজনৈতিক বিতর্ক নয়, এটি অনেক পরিবারের ইতিহাস, বেদনা, রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থান এবং ন্যায়বিচারের প্রতীক।
সুতরাং নির্বাচনের সময় এই ইস্যু সামনে এলে সংবেদনশীলতা আরও বাড়ে।
মির্জা আব্বাসের বক্তব্য—বিশেষত আওয়ামী লীগকে লক্ষ্য করে তার মন্তব্য—তাই স্বাভাবিকভাবেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে।
ধর্মীয় রাজনীতি ও নির্বাচনী পরিবেশ
বাংলাদেশের নির্বাচনগুলোতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর ভূমিকা সবসময়ই আলোচনায় থাকে।
অনেক সময় ভোটারদের ধর্মীয় অনুভূতিকে প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠে।
এবারের নির্বাচনী পরিবেশও তার ব্যতিক্রম নয়।
মির্জা আব্বাসের বক্তব্যে সেই বিষয়টিও উঠে এসেছে:
- ভোট না দিলে ধর্মীয় শাস্তির ভয় দেখানো
- সহিংসতার হুমকি
- ধর্মকে রাজনৈতিক অপপ্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার
এগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে।
আওয়ামী লীগ বনাম বিএনপি: দীর্ঘ দিনের দ্বন্দ্ব
বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল—আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সম্পর্ক সবসময়ই বিরোধপূর্ণ।
বিএনপির অভিযোগ
- সরকার অন্যায়ভাবে ক্ষমতা ধরে রেখেছে
- নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না
- বিরোধী দলের নেতাদের ওপর মামলা-হামলা চলছে
- প্রশাসনের ব্যবহার হচ্ছে রাজনৈতিক স্বার্থে
আওয়ামী লীগের পাল্টা অভিযোগ
- বিএনপি গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করতে চাইছে
- বিদেশি লবি কাজে লাগাচ্ছে
- রাজাকার ইস্যু নিয়ে অসত্য প্রচারণা চালায়
- ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে সহায়তা করে
এই পরিপ্রেক্ষিতে মির্জা আব্বাসের বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই রাজনৈতিক আলোচনার নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
মির্জা আব্বাসের রাজনৈতিক অবস্থান
মির্জা আব্বাস বিএনপির অন্যতম অভিজ্ঞ নেতা।
তিনি ঢাকার সাবেক মেয়র, সাবেক মন্ত্রী এবং দলের নীতিনির্ধারণী স্থায়ী কমিটির সদস্য।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি দলের পক্ষে রাজপথে আন্দোলনেও সক্রিয়।
তার বক্তব্য সাধারণত সরাসরি ও আক্রমণাত্মক হয়ে থাকে—যা তাকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রাখে।
জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান
বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে আহ্বান জানান—
“মানুষকে আমি শুধু বলব, এসব লোকের হাত থেকে দূরে থাকুন। দেশকে ভুল পথে নিতে দেওয়া যাবে না।”
তিনি বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক বিভাজন দেশের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতাকে ব্যাহত করছে এবং জনগণকে সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
২০২৫ সালের নির্বাচনকে ঘিরে উত্তেজনা
জানুয়ারি ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে:
- রাজনৈতিক দলগুলোর মাঠপর্যায়ের কার্যক্রম বৃদ্ধি পেয়েছে
- রাজনীতিকদের বক্তব্যে তীব্রতা বেড়েছে
- রাজাকার-আলবদর, ধর্ম, উন্নয়ন, দুর্নীতি—এসব ইস্যু সামনে চলে এসেছে
- জনমতের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চলছে সর্বত্র
মির্জা আব্বাসের বক্তব্য সেই নির্বাচনগত উত্তেজনাকেই আরও বৃদ্ধি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত
বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করেন:
- রাজাকার ইস্যু নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে সবসময় বড় ভূমিকা রাখে
- রাজনৈতিক ভাষা যত বেশি তীব্র হবে, তত বেশি মেরুকরণ হবে
- ধর্মীয় ইস্যু সামনে এলে ভোটারদের একটি অংশ সহজেই বিভ্রান্ত হয়
- আওয়ামী লীগ ও বিএনপির তীব্র বাকযুদ্ধ নির্বাচনী পরিবেশকে আরও জটিল করতে পারে
এ ধরনের বক্তব্য রাজনৈতিক অস্থিরতার ঝুঁকিও বাড়াতে পারে বলে তাদের মত।
বাংলাদেশের রাজনীতি সবসময়ই উত্তপ্ত। নির্বাচনের সময় তা আরও তীব্র হয়।
মির্জা আব্বাসের সাম্প্রতিক বক্তব্য সেই উত্তাপ বাড়িয়েছে।
তিনি রাজাকার ইস্যু, ধর্মীয় রাজনীতি এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা তুলে ধরে নতুন বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন।
আগামী নির্বাচনে এই ইস্যুগুলো কতটা প্রভাব ফেলবে—তা এখনো স্পষ্ট নয়।
তবে এটুকু নিশ্চিত, সামনে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন আরও উত্তেজনাপূর্ণ সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
MAH – 14118 I Signalbd.com



