নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলায় সরকারি খাসজমির ওপর রোপণ করা ৩১টি মেহগনি গাছ বিনা অনুমতিতে কাটার অভিযোগে বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান ভূঁইয়া ওরফে সুমনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। মামলার বাদী মাসকা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা মো. আবদুল জলিল। ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসার পর এলাকায় ব্যাপক আলোচনা, সমালোচনা এবং ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, সরকারি রাস্তা প্রশস্ত বা সংস্কারের নামে কোনো ব্যক্তি, এমনকি কোনো ঠিকাদারও কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট অনুমতি ছাড়া গাছ কাটতে পারেন না। অথচ এই ঘটনায় সেই মৌলিক আইনই লঙ্ঘন করা হয়েছে।
এই ঘটনার জেরে প্রশাসন তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে, যা বিস্তারিত প্রতিবেদন জমা দেবে। পাশাপাশি পুলিশ আসামিকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযান চালাচ্ছে।
রাস্তাটি পাকা করতে বরাদ্দ কোটি টাকা, গাছ কাটা হয় অনুমতি ছাড়া
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) মাসকা ইউনিয়নের দিঘলী–আলমপুর ৪ কিলোমিটার ১৫০ মিটার দীর্ঘ কাঁচা রাস্তা পাকা করতে ৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়। সরকারি এই প্রকল্পের কাজ পায় মোহাম্মদ ইউনুস অ্যান্ড ব্রাদার্স নামে একটি নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু স্থানীয়দের দাবি—পর্দার আড়াল থেকে প্রকৃত কাজ দেখভাল করছিলেন বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান ভূঁইয়া।
স্থানীয়রা জানান, ১৮ নভেম্বর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তার পাশে থাকা কমপক্ষে ৩১টি সরকারি মেহগনি গাছ কেটে ফেলা হয়। গাছগুলোর বাজারমূল্য প্রায় ৮ লাখ টাকা বলে ধারণা করছে প্রশাসন। তবে স্থানীয়দের দাবি, এত বড় গাছের বাজারমূল্য আরও অনেক বেশি।
সরকারি গাছ কাটতে হলে বন বিভাগ, উপজেলা প্রশাসন এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি লাগে। প্রয়োজন হলে টেন্ডার প্রক্রিয়ার মাধ্যমেও গাছ বিক্রি করতে হয়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে এসব নিয়ম–নীতি কোনোভাবেই মানা হয়নি।
গ্রামবাসীর অভিযোগ: ‘ইউএনওর নাম বলেই গাছ কেটে নেওয়া হয়েছে’
দিঘলী গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, তারা গাছ কাটতে বাধা দিলে ঠিকাদারের লোকজন প্রশাসনের নাম ব্যবহার করেন।
গ্রামবাসী জিলু মিয়া বলেন,
“২৫ বছর আগে সরকার রাস্তাটির পাশে মেহগনি গাছগুলো লাগিয়েছিল। তখন বলা হয়েছিল, ভবিষ্যতে গাছ বিক্রি হলে গ্রামবাসীও লাভের একটা অংশ পাবে। আমরা তাই এত বছর গাছগুলো দেখাশোনা করেছি। কিন্তু রাস্তা পাকাকরণের অজুহাতে বিএনপি নেতা রেজাউল গাছগুলো কেটে নিয়ে গেলেন। বিষয়টি খুবই অন্যায়।”
আরেক গ্রামবাসী সনজু রহমান বলেন,
“দিনভর গাছ কাটার পর রাতে যখন গাছ সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল, সন্দেহ হলে গ্রামবাসী শিমুলতলা বাজারের কাছে একটি গাড়ি আটক করে। সেখানে আমরা ৩৯টি ডোম পাই। পরে বিষয়টি প্রশাসনকে জানাই।”
এলাকার অনেকেই অভিযোগ করেছেন, গাছ কাটার কাজটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এমনকি গাছ কাটা ও পরিবহনের সময় বাইরে থেকে শ্রমিক আনা হয়েছে, যাতে স্থানীয়রা বাধা দিতে না পারেন।
বিএনপি নেতার ফোন বন্ধ, আগে বলেছিলেন ‘নিজ খরচে গাছ কেটেছি’
ঘটনা জানার পর স্থানীয় সাংবাদিকরা ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা রেজাউল হাসান ভূঁইয়ার মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তবে ঘটনার কয়েকদিন আগে তিনি স্থানীয়দের কাছে দাবি করেছিলেন—রাস্তা পাকা করার কাজে দ্রুততা আনতেই তিনি নিজ খরচে গাছগুলো কেটেছেন।
তিনি বলেছিলেন,
“প্রকল্পের সময়সীমা কম। তাই গাছ কেটে রাস্তা প্রশস্ত করা জরুরি ছিল। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করেই গাছগুলো কাটার পর এক জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছে।”
কিন্তু তদন্তের প্রাথমিক তথ্যে এসব বক্তব্যের কোনো ভিত্তি পাওয়া যায়নি বলে প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে।
প্রশাসনের কঠোর অবস্থান: ‘ইউএনওর নাম ভাঙিয়ে গাছ কাটা বেআইনি’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমদাদুল হক তালুকদার বলেন,
“ঠিকাদার কোনোভাবেই গাছ কাটতে পারেন না। আর ইউএনওর নাম ব্যবহার করে গাছ কাটা অপরাধ। আমরা ইতোমধ্যে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি আরও বলেন,
“সরকারি গাছ মানে রাষ্ট্রের সম্পদ। এগুলো কাটলে সরকারই ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জনগণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই এই বিষয়ে প্রশাসন খুব সতর্ক।”
প্রশাসন জানিয়েছে, অনুমতি ছাড়া গাছ কাটলে বন আইনসহ একাধিক আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। এর মধ্যে মামলা, জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধানও আছে।
মামলা ও আইনি প্রক্রিয়া
মাসকা ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আবদুল জলিল বাদী হয়ে সোমবার রাতে প্রথম আলোয় তথ্য থাকার ভিত্তিতে মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বিএনপি নেতা রেজাউল হাসান ভূঁইয়াকে। পাশাপাশি অজ্ঞাত চারজনকে আসামি করা হয়েছে, যারা গাছ কাটায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন।
কেন্দুয়া থানার ওসি মিজানুর রহমান বলেন,
“আসামিদের গ্রেপ্তারের জন্য পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। গাছগুলো কেটে কোথায় নেওয়া হয়েছে, কারা এতে যুক্ত, সবকিছু খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
পুলিশ বলছে, গাছ কাটার বিষয়টি শুধু মামলা নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ অপরাধ তদন্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ এ ঘটনায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
স্থানীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রকল্প বাস্তবায়নের জটিলতা
স্থানীয়দের মতে, এলাকায় প্রভাবশালী কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির দ্বন্দ্ব ও প্রতিযোগিতা এ প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রভাব ফেলতে পারে। এলজিইডির প্রকল্পটি সরকারি হলেও স্থানীয় নেতারা নানা সময়ে নিজেদের প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য নির্মাণ কাজে হস্তক্ষেপ করেন। এই প্রেক্ষাপটে রেজাউলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নতুন কোনো বিষয় নয় বলে অনেকেই মনে করছেন।
এ ছাড়া ঠিকাদারি কাজে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা থাকলে মাঠপর্যায়ে দায়িত্বশীলতা কমে যায়, যা সরকারি সম্পদের ক্ষতির পথ উন্মুক্ত করে। এই ঘটনার পর প্রশাসনও ঠিকাদারি কার্যক্রম আরও কঠোরভাবে নজরদারি করবে বলে জানিয়েছে।
গ্রামীণ উন্নয়ন ও গাছের ভূমিকা: বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
বন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা জানান, গ্রামীণ সড়কের পাশে গাছ শুধু সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বরং মাটি ধরে রাখে এবং পরিবেশ রক্ষা করে।
তিনি বলেন,
“রাস্তা প্রশস্ত করার সময় গাছ কাটার প্রয়োজন হলে তা আইন অনুযায়ী করতে হয়। অনুমতি, মূল্যায়ন, নিলাম—সব প্রক্রিয়া আছে। এগুলো মানা না হলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং দুর্নীতি বাড়ে।”
উন্নয়ন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামীণ সড়ক উন্নয়ন দেশের অবকাঠামো শক্তিশালী করতে বড় ভূমিকা রাখে। তবে উন্নয়ন প্রকল্পের আড়ালে দুর্নীতি হলে তা এলাকার মানুষের আস্থায় আঘাত হানে।
এলাকাবাসীর দাবি: ‘গাছের মূল্য গ্রামে ফিরিয়ে দিতে হবে’
দিঘলী ও আলমপুর এলাকার বহু পরিবার দাবি জানিয়েছেন—যদি গাছ কাটা হয়, তবে ন্যায্য হিসাব অনুযায়ী গ্রামবাসীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, কারণ তারা বহু বছর ধরে গাছের পরিচর্যা করেছেন। এ ছাড়া তারা চান ভবিষ্যতে এমন ঘটনা রোধে নজরদারি বাড়ানো হোক।
নেত্রকোনার এই ঘটনা শুধু গাছ কাটার অভিযোগ নয়; এটি স্থানীয় প্রশাসন, রাজনৈতিক প্রভাব এবং সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়বদ্ধতার একটি বড় পরীক্ষাও। তদন্ত প্রতিবেদন এবং মামলার অগ্রগতির ওপর নির্ভর করে সামনে কী হবে, তা এখন দেখার বিষয়।
MAH – 13985 I Signalbd.com



