বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন যখন আবারও নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে, তখন বিভিন্ন দল ও জোটের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমেই বাড়ছে। এমন প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামে আয়োজিত এক মাহফিলে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামির আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, দেশের আসন্ন নির্বাচন হবে সত্য ও অসত্য, ন্যায় ও অন্যায়ের একটি বড় পরীক্ষার মঞ্চ। সেখানে জনগণকে হকের পক্ষে দাঁড়াতে হবে। কোনো ভয় বা চাপ নয়, কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি ও বিবেকের নির্দেশনার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
শনিবার (২২ নভেম্বর) চট্টগ্রাম মহানগর হেফাজতে ইসলামের আমির মাওলানা তাজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে ফিরোজশাহ মাদ্রাসায় আয়োজিত মাহফিলে তিনি এসব কথা বলেন। দেশব্যাপী চলমান রাজনৈতিক উত্তাপ, দুর্নীতি, সুশাসনের সংকট, এবং ইসলামী মূল্যবোধভিত্তিক শাসনব্যবস্থার গুরুত্ব—এসব নিয়ে তিনি দীর্ঘ বক্তব্য দেন।
“আমাদের কুরআন এক, আল্লাহ এক, পথও এক” — ঐক্যের আহ্বান
ডা. শফিকুর রহমান বলেন,
“আমাদের কুরআন এক, আল্লাহ এক, নবী এক—আর আমাদের পথও এক হওয়া উচিত। যার কাছে আমরা যাব, আমাদের লক্ষ্যও সেই এক আল্লাহর সন্তুষ্টি। তাই আমাদের মধ্যে কোনো ভিন্নতা, বিভক্তি বা বিরোধ থাকা উচিত নয়। আল্লাহর দান এই বাংলাদেশ। আমি বহু দেশ ঘুরেছি, কিন্তু আমাদের দেশের মতো বরকতময় ভূমি খুব কমই দেখেছি।”
তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের প্রকৃতি, ভূগোল, সম্পদ ও মানুষের শ্রম—এসব মিলিয়েই দেশটিকে আল্লাহ বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন। কিন্তু এই সম্পদের চেয়ে বড় ঘাটতি হলো চরিত্রবান নেতৃত্বের অভাব। তার ভাষায়,
“অতীতে যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, তাদের নৈতিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা জাতির প্রত্যাশিত পর্যায়ে ছিল না। ফলে তারা জনসেবক না হয়ে মালিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এটা জাতির দুর্ভাগ্য।”
দেশের সম্পদ, সম্ভাবনা ও নেতৃত্ব সংকট
তিনি বলেন, “আমাদের দেশ নদী-নালা, পাহাড়-সমুদ্র, খনিজ—সব সম্পদে সমৃদ্ধ। কৃষি, গ্যাস, মাটি, মানবসম্পদ—সবই রয়েছে। কিন্তু নেতৃত্বের চরিত্রগত দুর্বলতা দেশের অগ্রগতিকে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। যখনই নেতৃত্ব দেশ পরিচালনার শক্তি পেয়েছে, তখনই তারা জনগণের সেবক হয়ে কাজ না করে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত হয়েছে।”
ডা. শফিকুর রহমান মনে করেন, দেশের রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা, বিচারহীনতা, মানবাধিকার সংকট, দুর্নীতি, দলীয়করণ—সবকিছুর মূলে রয়েছে নেতৃত্বের নৈতিক অবক্ষয়।
তিনি আরও বলেন,
“একজন সৎ নেতা জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে পারে। কিন্তু অসৎ নেতৃত্ব দেশকে বিপথে নিয়ে যায়। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জুলুম, ভয়, দমন-পীড়ন ব্যবহার করা হয়। এতে দেশ এগোয় না, বরং পিছিয়ে যায়।”
“ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ”
জামায়াত আমির বলেন,
“বাংলাদেশ এখন ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। আগামী নির্বাচনে সত্য-মিথ্যার, হক ও বাতিলের মধ্যে স্পষ্ট ফয়সালা হবে ইনশাআল্লাহ। এই নির্বাচনে আমাদের সবাইকে হকের পক্ষে থাকতে হবে। কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় করার সুযোগ নেই। ভয় করার একমাত্র সত্তা আল্লাহ।”
তার মতে, নির্বাচনে ভোট শুধু ভোটাধিকার নয়, বরং এটি ন্যায়-অন্যায়ের ওপর ব্যক্তিগত অবস্থান জানানোর সুযোগও বটে।
“প্রতিটি ভোট একটি ভেটো পাওয়ার। এখানে ভুল করার কোনো সুযোগ নেই। ভুল করলে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে।”
তিনি বলেন, যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে, যারা সুশাসন চায়, যারা ন্যায়বিচার চায়—তাদের প্রত্যেককে বিবেকের আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোনো প্রোপাগান্ডা, ভয় বা লোভ যেন ভোটারদের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত না করে।
“আমরা দলকে নয়, আল্লাহর দ্বীনকে বিজয়ী করতে চাই”
তার বক্তব্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল—দলীয় বিজয় নয়, আদর্শের বিজয়ের আহ্বান।
তিনি বলেন,
“আমরা কোনো দলকে বিজয়ী করতে চাই না। আমরা চাই আল্লাহর দ্বীনের বিজয়, জনগণের বিজয়। কোনো শয়তান যেন আমাদের মধ্যে বিভেদ তৈরি করতে না পারে—এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে।”
তিনি দাবি করেন, দেশের সাধারণ মানুষ বহু বছর ধরে জুলুম-অন্যায়ের শিকার। রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার, রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দুর্নীতির বেড়াজাল—এসব থেকে মুক্ত হতে মানুষ আজ পরিবর্তন চায়।
“এই মজলুম জনগণ আর যেন জুলুমের শিকার না হয়—এই দোয়াই আমরা করছি।”
চট্টগ্রামের মাহফিলে জনসমাগম—রাজনৈতিক বার্তার প্রসার
চট্টগ্রাম, বিশেষত হেফাজত-প্রধান এলাকাগুলোতে ধর্মীয় অনুষ্ঠান প্রায়ই রাজনৈতিক গুরুত্ব পেয়ে থাকে। দেশের ইসলামী রাজনীতির ইতিহাসে চট্টগ্রাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে। এ অঞ্চলে ধর্মীয় নেতৃত্বের বক্তব্য সাধারণ মানুষের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই জামায়াতের আমিরের এই বক্তব্য ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
মাহফিলে আসা শিক্ষার্থী, আলেম, রাজনৈতিক অনুসারীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। সেখানে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, ইসলামী মূল্যবোধ, নির্বাচন, ন্যায়বিচার—এসব বিষয় নিয়েই আলোচনা হয়।
“দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়া পর্যন্ত থামব না”
ডা. শফিকুর রহমান বলেন,
“আমরা দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। আল্লাহর রাজ প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম থামাব না। এখানেই আমাদের অঙ্গীকার।”
তিনি আরও বলেন, আদর্শিকভাবে ঐক্যবদ্ধ যেকোনো মানুষের সঙ্গেই জামায়াত কাজ করতে প্রস্তুত। মূল লক্ষ্য হলো আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুশাসন ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ: আগামী নির্বাচনের প্রভাব
বিশ্লেষকদের মতে, আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক ধরনের টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
নির্বাচন নিয়ে—
- রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ প্রস্তুতি
- ভোট পরিচালনা ব্যবস্থা
- মানবাধিকার ও ভিন্নমত দমনের অভিযোগ
- আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ
- ইসির নিরপেক্ষতা
—এসব বিষয় ইতোমধ্যে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে।
জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে নিবন্ধিত না থাকলেও তাদের নেতারা যে মাঠ পর্যায়ে সক্রিয়, তার কয়েকটি দৃশ্যমান চিত্র এ ধরনের মাহফিলে ফুটে ওঠে। বিশেষত ঐতিহ্যবাহী ইসলামী ঘরানার অঞ্চলে এই ধরনের বক্তব্য বৃহৎ জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রভাব বিস্তার করে।
জনগণের প্রত্যাশা: সুশাসন, নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার
দেশের সাধারণ মানুষের বড় অংশ আজ—
- মূল্যস্ফীতি,
- বেকারত্ব,
- দুর্নীতি,
- বিচারহীনতা,
- রাজনৈতিক অস্থিরতা
এগুলোর কারণে বাস্তব সংকটে রয়েছে। তাই নির্বাচনকে ঘিরে জনগণের প্রত্যাশা হলো এমন নেতৃত্ব, যারা নৈতিকতা, দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে পারবে।
ডা. শফিকুর রহমানের বক্তব্যে সেই প্রত্যাশার প্রতিফলন দেখা যায়। তিনি চান, জনগণ বিবেকের আলোকে সিদ্ধান্ত নিক; ভয় নয়, ন্যায় যেন জয়ী হয়।
চট্টগ্রামের এই মাহফিল শুধু ধর্মীয় আয়োজন ছিল না; এটি হয়ে উঠেছিল আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি তাৎপর্যপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা। জামায়াত আমিরের বক্তব্যে উঠে আসে—
- ঐক্যের আহ্বান
- নৈতিক নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা
- নির্বাচনকে হক-বাতিলের পরীক্ষার মঞ্চ হিসেবে দেখা
- দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান
- আদর্শভিত্তিক পরিবর্তনের দাবি
বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই বক্তব্যের গুরুত্ব অনেক।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে তাদের অবস্থান আরও দৃঢ় করতে চায়, সেখানে ডা. শফিকুর রহমানের এই আহ্বান ইসলামী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। আগামী দিনে এই বক্তব্য মাঠপর্যায়ে কীভাবে প্রভাব ফেলবে—তা সময়ই বলে দেবে।
MAH – 13933 I Signalbd.com



