নির্বাচনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের টেলিকম পলিসি পর্যালোচনা করবে বিএনপি: আমীর খসরু
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের পর যদি বিএনপি ক্ষমতায় আসে, তবে অন্তর্বর্তী সরকারের করা নতুন টেলিকম পলিসি কঠোরভাবে পর্যালোচনা বা রিভিউ করা হবে। শনিবার (২২ নভেম্বর) রাজধানীর একটি হোটেলে টেলিকম রিপোর্টারদের সংগঠন (টিআরএনবি) আয়োজিত এক সেমিনারে প্রধান বক্তা হিসেবে তিনি এই মন্তব্য করেন।
তিনি টেলিকম খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার অঙ্গীকার করেন এবং বলেন, এমন নীতি প্রণয়ন করা হবে, যেখানে দেশি-বিদেশি সবার স্বার্থেরই সুরক্ষা দেওয়া হবে, তবে দেশীয় উদ্যোক্তাদের গুরুত্ব নিশ্চিত করতে হবে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) ও টেলিকম খাতে বড় ধরনের নীতিগত ও কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
টেলিকম নীতি পর্যালোচনা: কেন এই উদ্যোগ?
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য জানান, জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতায় গেলে নতুন টেলিকম পলিসি পুনর্বিবেচনা করার প্রধান কারণ হলো, এই নীতিমালায় দেশীয় উদ্যোক্তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তিনি অভিযোগ করেন, বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) স্বাধীনতা কুক্ষিগত করে টেলিকম খাতকে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
তাঁর মতে, বর্তমান নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগকে অপ্রয়োজনীয় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা দেশীয় বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে। টেলিকম খাতে বিদেশি বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও তিনি বলেন, এর মানে এই নয় যে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করে একচেটিয়াভাবে বিদেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হবে। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি তৈরি করবে।
বিগত ১৫ বছরের অব্যবস্থাপনা ও দুর্বলতা
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে দেশের আইসিটি ও টেলিকম খাতের বর্তমান পরিস্থিতিকে অব্যস্থাপনা ও দুর্বলতার ফল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, বিগত বছরগুলোতে বিটিআরসি তার সাংবিধানিক ও আইনি স্বাধীনতা হারিয়েছে। ফলে এই খাতটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে জর্জরিত হয়ে পড়েছে।
তিনি উল্লেখ করেন, এই খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বিটিআরসিকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ না দেওয়ায় তা প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও সঠিক নীতি গ্রহণে ব্যর্থ হয়েছে। এই অব্যবস্থাপনার ফলস্বরূপ টেলিকম সেবার মান নিয়ে জনমনে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছে এবং দেশের অর্থনীতিতে এই খাতের সম্ভাব্য অবদান সীমিত হয়ে গেছে।
নতুন টেলিকম নীতিতে দেশীয় উদ্যোক্তাদের গুরুত্ব
নতুন টেলিকম নীতি পর্যালোচনার মূল লক্ষ্য হবে দেশীয় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। বিএনপির এই নেতা বলেন, আইসিটি ও টেলিকম খাতের ভবিষ্যৎ নীতিমালায় অবশ্যই দেশের ভেতরে থাকা প্রযুক্তিবিদ, প্রকৌশলী ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে সুরক্ষা দিতে হবে। দেশীয় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশি প্রতিযোগিতার সঙ্গে টিকে থাকার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।
তিনি দেশি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও সাইবার সুরক্ষার নিশ্চিত করার আহ্বান জানান। এই খাতে দেশীয় মেধা ও পুঁজি ব্যবহার করে দেশকে প্রযুক্তিগতভাবে স্বনির্ভর করে তোলার ওপর জোর দেন তিনি। তাঁর মতে, টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রণ দেশীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে না থাকলে জাতীয় নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতামত ও প্রতিক্রিয়া
একই সেমিনারে উপস্থিত গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকীও বিএনপির এই অবস্থানের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। তিনি মন্তব্য করেন, নতুন টেলিকম পলিসিতে বিদেশিদের প্রাধান্য দেওয়ায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেন, এ ধরণের নীতিমালা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হবে না।
জোনায়েদ সাকী দেশের টেলিকম নীতি প্রণয়নে দেশীয় শিল্প ও মেধার প্রতি মনোযোগী হওয়ার দাবি জানান। তার এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, বর্তমান টেলিকম নীতির সমালোচনা কেবল বিএনপির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং অন্যান্য বিরোধী দল এবং সংশ্লিষ্ট পেশাজীবী মহলেও এই বিষয়ে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর বক্তব্য: “বিগত ১৫ বছরে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) স্বাধীনতা কুক্ষিগত করে টেলিকম খাত ধ্বংস করা হয়েছে। আইসিটি ও টেলিকম খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন দরকার।”
সাইবার সুরক্ষা ও প্রযুক্তির স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণ
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী টেলিকম নীতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে সাইবার সুরক্ষা এবং তথ্য-প্রযুক্তির স্বাধীনতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, ডিজিটাল যুগে টেলিকম নেটওয়ার্ক ও আইসিটি কাঠামো দেশের নিরাপত্তা ও গণতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যক। তাই এই অবকাঠামোকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তার অধীনে আনা উচিত।
তিনি প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে জনগণের মৌলিক অধিকার এবং বাকস্বাধীনতাকে নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন। একটি গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন টেলিকম ব্যবস্থা গড়ে তোলার অঙ্গীকার করেন তিনি, যেখানে নজরদারি বা তথ্য নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তথ্য প্রবাহের স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে।
পরিবর্তনের অঙ্গীকার এবং ভবিষ্যতের অপেক্ষা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীর ঘোষণা দেশের আইসিটি ও টেলিকম খাতের ভবিষ্যৎ নীতিগত দিকনির্দেশনা নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি পর্যালোচনা করার এই অঙ্গীকার একদিকে যেমন দলটির রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির অংশ, তেমনি অন্যদিকে টেলিকম খাতের দীর্ঘদিনের জমে থাকা সমস্যাগুলোর সমাধান করার ইঙ্গিত দেয়। দেশীয় উদ্যোক্তাদের সুরক্ষা, বিটিআরসি’র স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনা এবং সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো নতুন নীতিমালার কেন্দ্রে থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে নির্বাচনের পর ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলে এই প্রতিশ্রুতিগুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়, সেদিকেই এখন সবার নজর থাকবে।
এম আর এম – ২৩২৬,Signalbd.com



