রাজনীতি

৫ আগস্টের পর দেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠার একটা সুযোগ এসেছে: চরমোনাই পীর

Advertisement

বাংলাদেশে গত বছরের ৫ আগস্ট-এর পর এমন একটি সময় এসে গেছে যখন ইসলামী আদর্শ ও নীতিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গড়ে তুলার সুযোগ দেখা দিয়েছে — এমন মন্তব্য করেছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম।

তিনি আরও বলেন, এই সুযোগ শুধুমাত্র রাজনৈতিক পরিবর্তনের চিহ্নই নয়, বরং মুসলিম কমিউনিটির মধ্যে এক নতুন দায়িত্ব ও প্রতিশ্রুতি জন্ম দিয়েছে — যে তাদের অগ্রগতি আর বিশ্বাস শুধু ব্যক্তিগত নয়, সুনির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

পীরের মূল বক্তব্য ও বিশ্লেষণ

চরমোনাই পীর রেজাউল করীম তার বক্তৃতায় বলেন, “গত ৫ আগস্টের পর দেশে ইসলামকে গাছের মতো মজবুত ভিত্তিতে দাঁড় করানোর জন্য সোনালি সময় এসে গেছে।” তার মতে, আযানের শব্দ যখন প্রতিদিন প্রতিটি মসজিদের মিনার থেকে প্রতিধ্বনিত হয়, তখন সেটি শুধুমাত্র ধর্মীয় কল্লোল নয় — এটি এক দীর্ঘমেয়াদী কাঠামোর ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে, যদি সক্রিয়ভাবে সেই সুযোগ কাজে লাগে।

তিনি আরও যুক্তি দেন, রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব মাত্র এখন আর সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। মুসলিমরা যদি একত্রে কাজ করে, তাহলে ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার ধর্মীয় ও সাংগঠনিক ভিত্তি গড়ে ওঠার পথ স্পষ্ট হবে।

সংখ্যালঘুদের প্রতি দৃষ্টি ও সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ

চরমোনাই পীর তার বক্তৃতায় এক পক্ষপাতমূলক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরেন। তিনি দাবি করেন, প্রতিবেশী ভারতের কিছু অংশ বিশেষ তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। তার ভাষায়, “ভারতের শকুনচক্ষু আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে — তারা চায় আমাদের দেশকে অশান্তিতে ফেলে দিতে, বিশেষত সংখ্যালঘুদের পথে চ্যালেঞ্জ তৈরি করে।”

এই ধরনের ধারণা পীর এমন সময় দিচ্ছেন যখন রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়েছে এবং ধর্মীয় ও সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের ইঙ্গিত শোনা যাচ্ছে। তাঁর মতে, “তাদের প্রচারণা হল — বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের জানমাল‑ইজ্জতের নিরাপত্তা নেই, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।” তিনি সতর্ক করেছেন যে এই ধরনের মিথ্যা দাবি শুধু দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা দেশের চিত্রকে নকল এবং বিপথগামীভাবে তুলে ধরা হচ্ছে।

জনগণের নিরাপত্তা ও সংহতির ওপর জোর

পীর রেজাউল করীম আরও বলেন, ইসলামী আন্দোলন এবং অনেক আলেম-ওলামার এক দায়িত্ব ছিল — সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা রক্ষা করা, তাদের জানমাল এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান রক্ষা করা। তিনি বলেন, “আমরা নামেছিলাম শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগ্রামে নয়, এক বৃহত্তর মানবিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব পালনের জন্য। আমাদের চাওয়া ছিল কোনো গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত না হোক, এবং দেশ যেন শান্তি ও সম্মান বজায় রেখে এগোতে পারে।”

উল্লেখযোগ্যভাবে, তিনি এও দাবি করেছেন যে ৫ আগস্টের পরে অনেক আলেম-ওলামা সরাসরি রাস্তায় নেমেছিলেন সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়াতে, তাদের হেফাজতে। এই মন্তব্যে ধর্মীয় সংহতির একটি বড় রাজনৈতিক বার্তা লুকিয়ে রয়েছে — যে ইসলামী নেতৃত্ব শুধু ধর্মীয় নয়, সামাজিক দায়িত্বও বটে।

ভারতের প্রভাব ও রাজনৈতিক বিস্তারিত

পীর রেজাউল করীম বলছেন, প্রতিবেশী ভারতের কিছু অংশ “চাঁদাবাজি এবং টেন্ডারবাজি” সহ নানা উপায়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করছে। তিনি অভিযোগ করেছেন যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্দিষ্ট চাপ তৈরি করে তাদের ইমেজ মেলে অন্য দেশ ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়, যা বাংলাদেশকে একটি বিভাজিত ও শঙ্কিত রাষ্ট্র হিসেবে উপস্থাপন করার চক্রান্ত বলে তার পাল্টা ব্যাখ্যা।

তার ভাষায়, “এরা রাতকে দিন বানাচ্ছে, দিনকে রাত; সংবাদ এমনভাবে গঠন করছে, যেন সত্যিই আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার নেই।” এই ধরনের বক্তব্যে পীর একটি আন্তর্জাতিক ও ভৌগলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরেন, যা শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণই নয়, আরও বিস্তৃত রাজনৈতিক ও কূটনীতিক দৃষ্টিভঙ্গা যোগ করে।

শিল্পকলা, একতা ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা

চরমোনাই পীর বলেন, ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের ভেতর একতা জরুরি। তিনি বিশেষভাবে নজর দিয়েছেন নারী সমাজের ভূমিকা-তে। তার মতে, নারীরা ইসলাম প্রতিষ্ঠার এই কাজের অগ্রভাগে থাকতে পারেন এবং “কল্যাণ রাষ্ট্র” গঠনের এই যাত্রায় তাঁদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য।

এই ভাবনার সঙ্গে পীর যুক্ত করেছেন রাজনৈতিক পন্থা এবং কাঠামোগত সিদ্ধান্তও: তিনি পিআর (অনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে ভোটাধিকার চান, যা দ্বিতীয় কিছু রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং দলের নেতৃত্বও সমর্থন করে। তাঁর যুক্তি হল, পিআর পদ্ধতিতে চাঁদাবাজি, দলগত আধিপত্য ও অর্থপাচার কম হবে।

দৃষ্টিভঙ্গা ও ভবিষ্যৎ নীতিমালা

পীর রেজাউল করীমের ধারনা অনুযায়ী, শুধু ধর্মীয় ঘোষণা বা মনোনীত বক্তব্য দিয়েই বিষয় সমাধান হবে না। ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হলে:

  1. রাজনৈতিক ঐক্য তৈরি করতে হবে — ইসলামী আন্দোলন সহ বিভিন্ন ইসলামী মৌলবাদী ও ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর মধ্যে মিল থাকতে হবে।
  2. নির্বাচন সংস্কার আনা জরুরি — পিআর পদ্ধতির মতো পন্থায় অংশ নেওয়া এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা বাড়ানো দরকার।
  3. সামাজিক সংহতি রক্ষা করতে হবে — ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকার রক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
  4. দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চাপে প্রতিরোধ গড়া — প্রতিবেশী দেশ, মিডিয়া ও আন্তর্জাতিক মহলে বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশের মুসলিমরাও তাদের নিজস্ব স্বাধীনতা ও গৌরব রক্ষা করতে সক্ষম।

সমালোচনা ও প্রাসঙ্গিক প্রশ্নসমূহ

চরমোনাই পীরের এই বক্তব্য রাজনৈতিকভাবে ইতিবাচক যেসব দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে, তাহলে কিছু গুরুতর প্রশ্নও উঠে আসে:

  • ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার ভিত্তি কি পুরোপুরি ধর্মীয় আদর্শে সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি তা নাগরিক অধিকার, সংখ্যালঘু সুরক্ষা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার সঙ্গে সমন্বয় করবে?
  • পিআর পদ্ধতির নির্বাচনী সংস্কার কি সত্যিই স্বাধীন এবং ন্যায়সঙ্গত হবে, নাকি রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর চাপে সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি করবে?
  • সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কি পীরের এই দৃষ্টিকোণকে বিশ্বাস করবে, বিশেষ করে যদি তাদের সামনে নিরাপত্তার অভাব বা রাজনৈতিক ও মিডিয়া চাপে ভীতির অবস্থা থাকে?
  • আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রতিবেশীর প্রভাব ও তাদের প্রচারণার বিরুদ্ধে কিভাবে কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা যাবে যাতে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ধর্মীয় সংহতি রক্ষা করা যায়?

চরমোনাই পীর মুফতি রেজাউল করীমের এ বক্তব্য—“৫ আগস্টের পর ইসলামকে রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ”—শুধু একটি ধর্মীয় মন্ত্রণা নয়, বরং রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক একটি বড় ঘোষণা। এটি একটি বাস্তবতার অঙ্গিকারকে প্রতিফলিত করে, যেখানে ধর্মীয় নেতা ও রাজনৈতিক আন্দোলন একসাথে কাজ করে এক নতুন দৃষ্টিকোণ এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে দেশকে।

যাইহোক, এই পথ সহজ হবে না। এতে চ্যালেঞ্জ রয়েছে — সার্বিক সামাজিক ঐক্য গঠন, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, নির্বাচনী সংস্কার আনা এবং আন্তর্জাতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার মোকাবিলা করার মতো বড় বড় বিষয়।

চরমোনাই পীরের কথাগুলো ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও ধর্মীয় আন্দোলনের জন্য এক নতুন দৃষ্টিপথ সূচনা করতে পারে। তাঁর আহ্বান কেবল ইসলামী মৌলবাদের সীমাবদ্ধ দৃষ্টিকোণ নয়, বরং একটি সামগ্রিক রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের চিন্তা, যা স্বপ্ন দেখায় — একদিকে ধর্মীয় প্রজ্ঞা, অন্যদিকে সমতার ভিত্তিতে গঠিত এক “কল্যাণ রাষ্ট্র”।

MAH – 13919 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button