লক্ষ্মীপুরে শারীরিক প্রতিবন্ধী ৩০ জন মানুষের হাতে হুইলচেয়ার তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। রবিবার (১৬ নভেম্বর) সকালে শহরের ইলেভেন কেয়ার একাডেমির প্রাঙ্গণে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এসব হুইলচেয়ার বিতরণ করা হয়। অনুষ্ঠানের সার্বিক আয়োজন করে লক্ষ্মীপুর শহর ও চন্দ্রগঞ্জ থানা জামায়াত।
এই কর্মসূচিকে স্থানীয়ভাবে বেশ উল্লেখযোগ্য ও প্রয়োজনীয় একটি মানবিক উদ্যোগ হিসেবে দেখা হচ্ছে। জেলার বিভিন্ন গ্রাম ও শহরাঞ্চল থেকে আগত হুইলচেয়ারপ্রাপ্ত প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের হাতেই সেদিন জিনিসগুলো তুলে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে চলাচলে সীমাবদ্ধতায় থাকা এসব পরিবারের সদস্যরা এতে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন ড. রেজাউল করিম
আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন লক্ষ্মীপুর-৩ আসনে জামায়াত মনোনীত জাতীয় সংসদ সদস্য (এমপি) প্রার্থী ড. মুহাম্মদ রেজাউল করিম। তিনি তার বক্তব্যে প্রতিবন্ধীদের সম্মান, অধিকার ও রাষ্ট্রীয় সেবাব্যবস্থার ত্রুটিগুলো তুলে ধরেন।
ড. করিম বলেন,
“প্রতিবন্ধীরা দেশের বা পরিবারের বোঝা নন। তারা দেশের মানুষ, দেশের সম্পদ। সুযোগ-সুবিধা দিলে এবং যথাযথ পরিচর্যা করলে তারা সমাজে অমূল্য অবদান রাখতে পারেন।”
তিনি আরও দাবি করেন, প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে সরকারের বরাদ্দ যথাযথভাবে বণ্টন হয় না বলে বহু মানুষ বঞ্চিত হন।
তার ভাষায়,
“সরকার প্রতিবন্ধীদের যে ভাতা ও সুবিধা দেওয়ার কথা বলে, তা অনেক ক্ষেত্রেই সময়মতো দেওয়া হয় না। আর যেটুকু দেওয়া হয়, তার অংশও কোনো কোনো অসাধু রাজনীতিবিদ ও আমলা আত্মসাৎ করেন—এটা খুব দুঃখজনক।”
তিনি কঠোর ভাষায় দুর্নীতিবাজদের সমালোচনা করে বলেন,
“আপনারা প্রয়োজনে ভিক্ষা করে খান, কিন্তু এতিম, অসহায় ও প্রতিবন্ধীদের হক মেরে খাবেন না। এটি অমানবিক।”
এ সময় তিনি ঘোষণা দেন,
“আমরা ভবিষ্যতে দাঁড়িপাল্লা প্রতীকে জয়ী হলে লক্ষ্মীপুরে প্রতিবন্ধীদের জন্য আলাদা হাসপাতাল ও বিশেষায়িত সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করবো।”
আয়োজনে ছিলেন জেলা ও শহর জামায়াতের নেতারা
অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন—
- জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মাওলানা নাছির উদ্দীন মাহমুদ,
- শহর জামায়াতের আমীর এডভোকেট আবুল ফারাহ নিশান,
- নায়েবে আমীর মাওলানা জহিরুল ইসলাম,
- জেলা যুব বিভাগের সভাপতি শামছুল ইসলাম,
- স্থানীয় বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী ও সেবাধর্মী সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
প্রতিবন্ধী সেবায় হুইলচেয়ারের গুরুত্ব
বাংলাদেশের প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ চলাচলজনিত সমস্যায় ভোগেন। অনেকেরই নিজস্ব হুইলচেয়ার কেনার সামর্থ্য নেই, বিশেষ করে নিম্ন আয়ের পরিবারের ক্ষেত্রে এটি প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও এবং রাজনৈতিক সংগঠন সময়সময় হুইলচেয়ার বিতরণ করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
হুইলচেয়ার কেবল চলাচল সহজই করে না, এটি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তির—
- স্বাধীনতা বৃদ্ধি,
- শিক্ষার সুযোগ,
- চাকরির সুযোগ,
- ব্যক্তিগত মর্যাদা,
- পরিবারের উপর নির্ভরতা কমানো,
- মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি,
- সামাজিক অংশগ্রহণ,
সব ক্ষেত্রেই ইতিবাচক ভূমিকা রাখে।
জাতীয় প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশে প্রায় ১ কোটির বেশি প্রতিবন্ধী মানুষ বিভিন্ন সুবিধা থেকে বঞ্চিত। এর মধ্যে অনেকেই সরকারের ভাতা ও মেডিকেল সহায়তা নিয়মিত পান না। ফলে এমন উদ্যোগগুলো তাদের জীবনে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
স্থানীয় পরিবারের প্রতিক্রিয়া
হুইলচেয়ারপ্রাপ্ত পরিবারগুলোর সদস্যদের মুখে ছিল কৃতজ্ঞতা ও স্বস্তির ছাপ।
চন্দ্রগঞ্জ এলাকার ৪৮ বছর বয়সী মিনারা বেগম বলেন,
“ছয় বছর ধরে আমার স্বামীকে কোলে-কাঁধে করে চলতে হয়। আজ হুইলচেয়ার পাওয়ায় আমাদের কষ্ট অনেকটা কমবে।”
আরেকজন সুবিধাভোগী বিদ্যালয়পড়ুয়া রাফসান (১৪) জানান,
“হুইলচেয়ার থাকলে এখন থেকে আমি নিয়মিত স্কুলে যেতে পারবো। বাবা আর প্রতিদিন আমাকে কোলে করে নিতে হবে না।”
এমন প্রতিক্রিয়াগুলো এ ধরনের উদ্যোগকে আরও অর্থবহ করে তোলে।
হুইলচেয়ার বিতরণকে কেন্দ্র করে নির্বাচনকালীন আলোচনাও
যদিও এটি সামাজিক সহায়তা কর্মসূচি, তবুও স্থানীয়ভাবে অনেকে দাবি করছেন, নির্বাচনী সময় ঘনিয়ে আসায় রাজনৈতিক দলগুলো মানবিক কার্যক্রমে আরও সক্রিয় হয়েছে। তবে আয়োজকরা বলছেন, এটি পুরোপুরি সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবন্ধীদের নিয়ে যে সমস্যাগুলো রয়েছে, সেগুলোর সমাধানে তাদের ভূমিকা রাখতে চান।
একজন স্থানীয় নেতা বলেন,
“এটি রাজনৈতিক প্রচারণা নয়; বরং সমাজের অবহেলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর একটি ছোট চেষ্টা।”
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী সেবার বর্তমান চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রকল্প থাকলেও বাস্তবচিত্র ভিন্ন।
প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো—
- পর্যাপ্ত বাজেটের ঘাটতি
- গ্রামের মানুষদের ভাতা পেতে ঝামেলা
- মেডিকেল সেবা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের অভাব
- চাকরি কোটা কার্যকর না হওয়া
- সহায়ক উপকরণ সরবরাহ সীমিত
- পরিবারে আর্থিক চাপ
- প্রতিবন্ধীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সংকট
এ কারণে অনেকে কর্মক্ষম হয়েও ঘরবন্দি হয়ে পড়েন।
স্থানীয় পর্যায়ে সেবামূলক উদ্যোগ বাড়ানোর আহ্বান
সামাজিক সংগঠন, এনজিও, রাজনৈতিক দলসহ সব প্রতিষ্ঠানকে এই ধরনের সহায়তা কর্মসূচি নিয়মিত চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা। তাদের মতে, একটি হুইলচেয়ার কেবল যন্ত্র নয়—এটি একজন মানুষের জীবনে নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়।
আয়োজকদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জামায়াত নেতারা জানান,
- প্রতিবন্ধীদের সেবায় স্থায়ী একটি তহবিল গঠন,
- নিয়মিত চিকিৎসা ক্যাম্প,
- র্যাম্প ও হুইলচেয়ার-বান্ধব অবকাঠামো তৈরি,
- শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ স্কলারশিপ চালু করার পরিকল্পনাও রয়েছে।
তারা দাবি করেন, যদি জনগণ আস্থা রাখে এবং তাদের রাজনৈতিকভাবে সুযোগ দেয়, তবে তারা লক্ষ্মীপুরকে “অসহায়বান্ধব জেলা” হিসেবে গড়ে তুলতে চান।
লক্ষ্মীপুরে প্রতিবন্ধীদের মাঝে হুইলচেয়ার বিতরণের এই ছোট উদ্যোগ স্থানীয় মানুষের কাছে বড় গুরুত্ব বহন করছে। চলাচল অক্ষম ব্যক্তিদের জীবনে এমন সহায়তা শুধু মানবিক দায়িত্বই নয়, সমাজের প্রতি নৈতিক দায়ও বটে। এ ধরনের উদ্যোগ আরও বাড়লে দেশের বিপুল সংখ্যক প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী তাদের জীবনমান উন্নত করতে পারবে—এমন আশা অনেকের।
MAH – 13830 I Signalbd.com



