ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম বলেছেন, বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিকভাবে এক সংবেদনশীল সময়ে রয়েছে। জনগণের ভোটাধিকারকে অর্থ-বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রভাবিত করতে বিএনপি বহু বছর ধরে যে ধরনের কার্যক্রম চালিয়েছে, তাতে তাদের কাছে দেশের ভবিষ্যৎ কখনোই নিরাপদ নয়। তার দাবি, “অর্থ দিয়ে ভোট কেনার যুগ শেষ। বিএনপি অতীতে যেভাবে জনগণের শ্রমের টাকা চাঁদা তুলে সংগ্রহ করেছে, এখন তারা সেই টাকাতেই আবার ভোটের বাজার গরম করার চেষ্টা করছে।”
শনিবার (১৫ নভেম্বর) সকালে মেহেরপুর জেলা ছাত্রশিবির আয়োজিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। সমাবেশে জেলা শিবিরের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা ছাড়াও শিক্ষাবিদ, স্থানীয় সমাজকর্মী ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
“বিএনপি হাজার কোটি টাকা চাঁদা তোলে, আর ১০০ কোটি টাকা দেখিয়ে জনগণের চোখে ধুলো দেয়” — সাদ্দাম
তার বক্তব্যে বিএনপির অর্থনীতি ও সাংগঠনিক নীতির ওপর কঠোর সমালোচনা করেন তিনি।
বলেন—
“বিএনপি ১ হাজার–২ হাজার কোটি টাকা চাঁদা তোলে। তারপর জনগণের চোখে ধুলো দিতে হয়তো ১০০ কোটি টাকা বিলায়। তারা মনে করে, টাকা বিলালেই জনগণকে কেনা যায়। কিন্তু দেশের মানুষ এখন অনেক সচেতন। বিএনপিকে ভোট দিলে তারা আবার চাঁদা তুলে সেই টাকা উসুল করবে।”
তিনি দাবি করেন, রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করলে দেখা যাবে বিএনপির আমলেই দেশের বড় বড় চাঁদাবাজি চক্র সক্রিয় ছিল। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনকে চাপ দিয়ে, প্রকল্প বাণিজ্যের মাধ্যমে এবং প্রভাবশালী ক্যাডারদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে বিএনপি অতীতে ‘একটি অর্থনৈতিক মাফিয়া চক্র’ তৈরি করেছিল বলে তিনি অভিযোগ করেন।
“বিএনপি কখনো নিজেদের টাকা বিলায় না” — ছাত্রশিবির নেতা
বক্তৃতায় সাদ্দাম উল্লেখ করেন—
“বিএনপি রাজনীতিতে এত বড় ‘দাতা’ নেই যে নিজেদের টাকা জনগণের মাঝে বিলাবে। বিএনপি কখনো নিজেদের লোকদের অর্থ খরচ করে না। তারা সবকিছুই করে জনগণের মাথার ওপর ভর করে। এই দল ক্ষমতায় গেলে চাঁদাবাজি করে জনগণের পকেট থেকেই সেই টাকা তুলে নেয়।”
তিনি বলেন,
দলটির অভ্যন্তরে আন্তঃকোন্দল, ক্ষমতা দখল, আর্থিক প্রতিযোগিতা ও গ্রুপিং এত বেশি যে নিজেদের মধ্যেই খুনোখুনি পর্যন্ত হয়েছে।
শিবিরের নাম ব্যবহার করে শহীদের তালিকা ভরানোর অভিযোগ
বক্তব্যের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে সাদ্দাম অভিযোগ করেন যে বিএনপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে শহীদের তালিকা প্রকাশ করে, তার অনেকটাই ‘ভুয়া’ বা ‘মিথ্যাভাবে তৈরি’।
তার ভাষায়—
“জুলাই মাসে যারা শহীদের কথা বলে তারা নিজেরাই জানে — এতো শহীদ তাদের নেই।
তারা যে ১৫৫ জনের তালিকা প্রকাশ করেছিল, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল ছাত্রশিবিরের কর্মী। নিজেদের তালিকা ভরানোর জন্য তারা আমাদের শহীদের নাম ব্যবহার করেছে।”
এ অভিযোগ নিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে। ছাত্রশিবিরের নেতারা আরও দাবি করেন, বিএনপি অতীতে আন্দোলনের সময় শিবিরের কর্মীদের অনেকে নিহত হওয়া সত্ত্বেও সেই ঘটনাগুলোকে নিজেদের নামে প্রচার করেছে। ছাত্রশিবির মনে করে, এটি শুধু রাজনৈতিক অনৈতিকতা নয়, বরং শহীদের পরিবারের প্রতি চরম অবমাননা।
মেহেরপুরে সমাবেশ: কী বার্তা দিতে চাইলো শিবির?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, মেহেরপুরে ছাত্রশিবিরের এই সমাবেশটি ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষ করে মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও চুয়াডাঙ্গা অঞ্চল অতীতে শিবিরের শক্তিশালী এলাকা হিসেবে পরিচিত।
এই অঞ্চলে কয়েক বছর নিস্ক্রিয় থাকার পর শিবির আবার সাংগঠনিকভাবে মাঠে নামছে বলে মনে করছেন স্থানীয় পর্যবেক্ষকরা।
সমাবেশে ছিল—
- শিক্ষার্থী ও ইসলামপন্থী সংগঠনের উপস্থিতি
- স্থানীয় গণমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য
- সাংগঠনিক নির্দেশনা ও কর্মপদ্ধতি
- নির্বাচনকে সামনে রেখে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান
শিবির নেতারা বলেন, তারা নির্বাচনে সরাসরি অংশ নিচ্ছে না, তবে দেশ ও সমাজ গঠনে শিক্ষার্থীদের দায়িত্বের জায়গা থেকে তারা সচেতনতা তৈরি করবে।
নির্বাচনী প্রেক্ষাপট: কেন আবার ‘বিএনপি বনাম ইসলামপন্থী সংগঠন’ বিতর্ক উঠছে?
২০২৫ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ তৈরি হয়েছে।
বিএনপি একদিকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছে, অন্যদিকে মাঠে প্রচারের মাধ্যমে ‘জনগণের রায়’ নেওয়ার চেষ্টা করছে।
কিন্তু ইসলামি সংগঠনগুলো বিএনপির ওপর যে অভিযোগগুলো করছে, সেগুলো মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে—
১️⃣ অর্থনৈতিক চাঁদাবাজি
বিগত সময়ে বিএনপির ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়:
- টেন্ডারবাজি
- ব্যবসায়ীদের ওপর প্রভাব
- দলীয় ক্যাডারদের চাঁদা তোলা
- ব্যাংক লুট, অর্থপাচার
এসব অভিযোগ বহুবার উঠেছে।
২️⃣ সংঘাত-সহিংসতার রাজনীতি
২০০১-২০০৬ মেয়াদে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ব্যাপকভাবে বেড়েছিল।
এ সময় শিবিরের ওপরও হামলা হয়েছিল বলে দাবি করে ইসলামী সংগঠনগুলো।
৩️⃣ ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর ‘যৌথ আন্দোলনে ব্যবহৃত হওয়া’ অভিযোগ
২০০৬–২০১৩ পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলনে বিএনপি ইসলামি দলগুলোকে সামনে রেখেছিল বলে অভিযোগ আছে।
পরে তাদের ‘ত্যাগী কর্মীদের’ তালিকায় যারা ছিল, তাদের অনেকেই নাকি শিবিরের কর্মী—এটাই সাদ্দামের বক্তব্যের মূল পয়েন্ট।
বিএনপির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কতটা প্রভাব ফেলতে পারে?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন—
- বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বিএনপির বিরুদ্ধে ‘চাঁদাবাজির’ অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
- তবে শিবিরের মতো সংগঠন এটি সামনে তুলে ধরায় বিষয়টি নতুন আলোচনার জন্ম দিতে পারে।
- শিবিরের দাবি করতে চাওয়া বার্তাটি হলো: “বিএনপি আমাদের হত্যা করেছে, আমাদের নাম ব্যবহার করেছে, আমাদের বিশ্বাসের ওপর আঘাত করেছে।”
- এ ধরনের বক্তব্য একদিকে বিএনপির ইসলামি ভোটব্যাংকে চাপ তৈরি করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন—
“ইসলামী ছাত্রশিবিরের বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক অভিযোগ নয়, এটি একটি ‘ঐতিহাসিক ক্ষোভ’র বহিঃপ্রকাশ। তারা মনে করে বিএনপি ইসলামপন্থী শক্তিকে আন্দোলনে ব্যবহার করে, কিন্তু প্রয়োজন ফুরালে তাদের ত্যাগ করে দেয়।”
স্থানীয় জনমত: মেহেরপুরে কোন বার্তা সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে?
মেহেরপুরে বেশ কয়েকজন স্থানীয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়—
- বিএনপির বিরুদ্ধে ‘চাঁদাবাজির’ অভিযোগ পুরনো হলেও
- শিবিরের শহীদের তালিকা ব্যবহারের অভিযোগটি সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে
একজন শিক্ষক বলেন—
“রাজনীতিতে মিথ্যা প্রচার নতুন নয়। কিন্তু শহীদের তালিকা নিয়ে কারসাজি খুবই সংবেদনশীল বিষয়।”
একজন ব্যবসায়ী বলেন—
“চাঁদাবাজি নিয়ে মানুষ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যেই দল এগুলোর জোরালো কাঠামো গড়ে তুলেছিল, তাদের কাছে মানুষ নিরাপত্তা খুঁজবে কেন, সেটাই সবাই ভাবছে।”
সাদ্দামের আহ্বান: ‘যে দল অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছে, তাদের হাতে দেশ তুলে দেওয়া যাবে না’
বক্তৃতার শেষাংশে নুরুল ইসলাম সাদ্দাম শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন—
“যে দল অতীতে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, দুর্নীতির রাজত্ব করেছে, নিজেদের লোকদের চাঁদাবাজির মাধ্যমে ধনী করেছে—তাদের হাতে দেশ তুলে দেওয়া যাবে না।
নির্বাচনের আগে-পরে যে কোনো রাজনৈতিক অপপ্রচার থেকে তরুণদের দূরে থাকতে হবে। সত্য, ন্যায় ও শান্তির রাজনীতি প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য।”
তিনি আরও বলেন,
“দেশের ভবিষ্যৎ শিক্ষার্থীদের হাতে। আর শিক্ষার্থীরা কখনোই অর্থে কেনা যায় না।”
MAH – 13819 I Signalbd.com



