রাজনীতি

৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এনসিপি: নাহিদ

Advertisement

বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে নতুন অধ্যায়ের ইঙ্গিত দিল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন—আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনসিপি দেশের ৩০০ আসনেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
রবিবার রাজধানীর বাংলামোটরে দলীয় অস্থায়ী কার্যালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ ঘোষণা দেন।

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা এখন পর্যন্ত ৩০০ আসন ধরেই এগোচ্ছি। আমরা হয়তো এই মাসেই প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করব। কে কোন আসনে লড়বেন, সেটি তখন সবাই দেখতে পাবেন। আমাদের অনেক কর্মী ইতিমধ্যে নিজেদের এলাকায় কাজ শুরু করেছেন।”

নতুন দল, কিন্তু বড় লক্ষ্য

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বাংলাদেশের রাজনীতিতে একেবারেই নতুন একটি দল। ২০২৪ সালের শেষের দিকে গঠিত এই রাজনৈতিক সংগঠনটি শুরু থেকেই নিজেকে ‘জনগণের অধিকার ও নাগরিক অংশগ্রহণ’-ভিত্তিক রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরছে।
দলটির নেতৃত্বে রয়েছেন তরুণ রাজনীতিক ও সমাজকর্মী নাহিদ ইসলাম, যিনি দীর্ঘদিন নাগরিক আন্দোলন ও সামাজিক উন্নয়ন কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দলের অন্যতম লক্ষ্য—রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব গড়ে তোলা এবং প্রচলিত দলগুলোর বাইরে একটি বিকল্প নাগরিকমুখী রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা নতুন দল হলেও জনগণের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি। এনসিপি জনগণের জন্য, নাগরিক অধিকারের জন্য, স্বচ্ছ রাজনীতির জন্য।”

ঢাকা থেকেই প্রার্থী হতে পারেন নাহিদ ইসলাম

সাংবাদিকদের প্রশ্নে নাহিদ ইসলাম জানান, তিনি নিজেও আসন্ন নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন। সম্ভাব্য আসন নিয়ে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে তিনি ঢাকা থেকেই প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দেন।

তিনি বলেন, “আমি নিজে ঢাকার রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন যুক্ত। এখানকার মানুষ আমাকে চেনে। তাই যদি দল চায়, আমি ঢাকাতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব।”

‘দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন দেশের স্থিতিশীলতার জন্য’

নির্বাচনের সময় নিয়ে প্রশ্ন করলে এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, “আমরা দ্রুত নির্বাচন চাই। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে সেটিই দেশের জন্য ভালো হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দ্রুত নির্বাচন প্রয়োজন।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা হয়তো সংগঠন হিসেবে এখনো পরিপূর্ণভাবে প্রস্তুত নই, কিন্তু আমরা নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নই। নির্বাচন দেশের গণতন্ত্রের প্রাণ, তাই সেটা যত দ্রুত সম্ভব হওয়া উচিত।”

দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে এনসিপি

নাহিদ ইসলাম স্পষ্ট করেন, এনসিপি শুধু এক নির্বাচনের জন্য তৈরি নয়। বরং দলটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমেছে।

তিনি বলেন, “এই নির্বাচন আমাদের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ, প্রথম পরীক্ষা। আমরা এতে অংশ নেব। মানুষ দেখবে আমাদের কাজ, আমাদের প্রতিশ্রুতি, আমাদের মানসিকতা। ভালো বা খারাপ—সবকিছুই জনগণ বিবেচনা করবে।”

দলটির নেতারা বলছেন, তারা আগামী দশ বছরকে সামনে রেখে দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তনের একটি ‘নাগরিক উন্নয়ন রূপরেখা’ তৈরি করছেন। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ, তরুণ উদ্যোক্তা সহায়তা, এবং দুর্নীতি দমনমূলক কার্যক্রমের ওপর জোর দেওয়া।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা যা বলছেন

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে এনসিপির এই ঘোষণা বাংলাদেশের নির্বাচনী রাজনীতিতে একটি নতুন গতি তৈরি করতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক (অব.) ড. শাহীন আরা বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন দলগুলোর সক্রিয় অংশগ্রহণ একটি ইতিবাচক দিক। এনসিপি যদি বাস্তবসম্মত প্রার্থী ও পরিষ্কার কর্মসূচি দিতে পারে, তাহলে তারা তরুণ ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে।”

তবে তিনি সতর্ক করেন, “তাদের সংগঠন কাঠামো ও মাঠপর্যায়ের উপস্থিতি এখনো সীমিত। নির্বাচনে ৩০০ আসনে অংশ নেওয়া একটি বিশাল দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব সফলভাবে পালন করতে তাদের সক্ষমতা প্রমাণ করতে হবে।”

রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের আকর্ষণ

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নাগরিক আন্দোলনের মাধ্যমে তারা নানা ইস্যুতে সরব হচ্ছে।

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা দেখেছি, তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আস্থা কমে গেছে। তারা মনে করে রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতার খেলা। আমরা সেই ধারা ভাঙতে চাই। আমরা চাই তরুণরা রাজনীতিকে ইতিবাচকভাবে দেখুক।”

তিনি আরও যোগ করেন, “এনসিপি এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে চায়, যেখানে ছাত্র, যুবক, নারী, শ্রমিক—সবাই সমানভাবে অংশ নিতে পারবে। আমাদের দলের নামই বলছে—‘নাগরিক পার্টি’। নাগরিকরাই আমাদের মূল শক্তি।”

এনসিপির সাংগঠনিক প্রস্তুতি

দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বর্তমানে বাংলামোটরে অবস্থিত। তবে নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, ইতিমধ্যে দেশের ৫৬টি জেলায় দলীয় কমিটি গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে

তিনি বলেন, “আমাদের লক্ষ্য ডিসেম্বরে সব জেলার সাংগঠনিক কাঠামো গঠন সম্পন্ন করা। প্রতিটি জেলায় কর্মশালা ও সভা করছি। আমাদের টিম এখন মাঠে।”

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এনসিপির প্রাথমিক সদস্য সংখ্যা ইতিমধ্যে দেড় লক্ষাধিক ছাড়িয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ উদ্যোক্তা, শিক্ষক, আইটি পেশাজীবী ও এনজিও কর্মী।

ভোটের মাঠে নতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা

বর্তমানে জাতীয় রাজনীতি দুই প্রধান জোটের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সীমাবদ্ধ। তবে এনসিপি এই প্রথাগত কাঠামোর বাইরে গিয়ে “তৃতীয় রাজনৈতিক বিকল্প” হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়।

রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে—এনসিপির প্রার্থী দিলে, বিশেষ করে নগর ও তরুণ প্রভাবিত এলাকায়, ভোটের সমীকরণে কিছু পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এক রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, “যদি তারা ৩০০ আসনে প্রার্থী দেয় এবং ন্যূনতম প্রচারণা চালাতে পারে, তাহলে কয়েকটি জায়গায় ‘স্পয়লার’ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে জাতীয় পর্যায়ে বড় প্রভাব ফেলতে গেলে তাদের জোট রাজনীতি ও মিডিয়া উপস্থিতি বাড়াতে হবে।”

দলের নীতিমালা ও ঘোষিত লক্ষ্য

এনসিপি তাদের প্রাথমিক রাজনৈতিক ঘোষণাপত্রে তিনটি মূল নীতি ঘোষণা করেছে—
১. স্বচ্ছ রাজনীতি ও জবাবদিহিতা
২. নাগরিক অংশগ্রহণ ও বিকেন্দ্রীকরণ
৩. মানবিক অর্থনীতি ও সামাজিক ন্যায্যতা

দলটি বলছে, তারা “অর্থনীতির কেন্দ্র থেকে রাজনীতি নয়, রাজনীতির কেন্দ্র থেকে অর্থনীতি”—এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করছে। অর্থাৎ রাজনীতিকে জনগণের মৌলিক প্রয়োজন ও উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করতে চায় তারা।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নজর রাখতে চায় এনসিপি

নাহিদ ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ভূরাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় দাঁড়িয়ে। আমরা চাই, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান নিক। এজন্য নীতিনিষ্ঠ কূটনীতি, আঞ্চলিক সহযোগিতা, এবং দেশের রপ্তানি ও প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা রাজনীতি করব আধুনিক বাংলাদেশের ভাবনা নিয়ে—যেখানে প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সুশাসন একসঙ্গে চলবে।”

আগামী দিনের লক্ষ্য

এনসিপি এখন পূর্ণমাত্রায় নির্বাচনী প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। নভেম্বরের মধ্যেই প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করা হবে বলে জানা গেছে। এরপর ডিসেম্বর মাস জুড়ে থাকবে প্রচারণা, সংগঠন শক্তিশালীকরণ ও ভোটার সংযোগ কার্যক্রম।

নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা হয়তো বড় দল নই, কিন্তু আমাদের উদ্দেশ্য বড়। এই নির্বাচনে আমাদের লড়াই হচ্ছে আশা ও পরিবর্তনের পক্ষে।”

তিনি আরও বলেন, “বাংলাদেশের মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। সেই পরিবর্তনের নেতৃত্ব দিতে এনসিপি প্রস্তুত।”

MAH – 13598 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button