রাজনীতি

ভারতে মারা গেলেন আ. লীগের সাবেক এমপি

Advertisement

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক সময় সক্রিয় ও প্রভাবশালী নারী নেত্রী ছিলেন কনিকা বিশ্বাস—বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠক। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন ও ত্যাগের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থাকা এই প্রবীণ নেত্রী ভারতের কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।

জানা গেছে, তিনি বার্ধক্যজনিত নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার কাছাকাছি সল্টলেকের মণিপাল হাসপাতালে কয়েকদিন ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। বুধবার (৩০ অক্টোবর ২০২৫) বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

জন্ম ও প্রাথমিক জীবন

কনিকা বিশ্বাসের জন্ম বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার ওড়াকান্দিতে, যা এখন বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক ও ধর্মীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। তাঁর শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ওড়াকান্দির স্নিগ্ধ গ্রামীণ পরিবেশে। ছোটবেলা থেকেই তিনি সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে আগ্রহী ছিলেন এবং নারী শিক্ষার প্রসারে কাজ করতেন।

তাঁর বাবা-মা দুজনেই শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছিলেন। পারিবারিক পরিবেশেই তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা, মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং সমাজের জন্য কিছু করার শিক্ষা পান। এভাবেই ধীরে ধীরে রাজনীতির প্রতি আগ্রহ জন্ম নেয় তাঁর মনে।

রাজনীতিতে পদার্পণ ও সংগ্রামের সূচনা

কনিকা বিশ্বাসের রাজনৈতিক জীবনের সূচনা ঘটে পাকিস্তান আমলে। তিনি ছাত্রজীবন থেকেই আওয়ামী লীগের আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন চলাকালীন সময়ে তিনি নারী কর্মী হিসেবে সংগঠিত ছিলেন। নারী সমাজকে ভাষার অধিকার আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে তিনি বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এরপর ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের পক্ষে প্রচারণায় অংশ নেন এবং গ্রামীণ নারীদের রাজনৈতিকভাবে সচেতন করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

ছয় দফা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের সময়কার ভূমিকা

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলন যখন সমগ্র বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করে, তখন কনিকা বিশ্বাস সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। গ্রামে গ্রামে সভা-সমাবেশে নারীদের সংগঠিত করে তিনি আন্দোলনের পক্ষে জনমত গড়ে তোলেন।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, কনিকা বিশ্বাস সরাসরি যুদ্ধে অংশ না নিলেও সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা, নারীদের নিরাপত্তা এবং শরণার্থী ত্রাণ কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে তিনি বাংলাদেশি শরণার্থীদের সহায়তায় সক্রিয় ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ সদস্য

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে, কনিকা বিশ্বাসকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নারী আসন-১১ থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত করা হয়। তিনি সংসদে নারী অধিকার, শিক্ষা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও স্বাস্থ্যসেবার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন।

সেই সময় সংসদে নারীর সংখ্যা ছিল অল্প, কিন্তু কনিকা বিশ্বাস ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম সক্রিয় ও প্রভাবশালী সদস্য। তিনি নারী নেতৃত্বের গুরুত্ব নিয়ে বারবার সংসদে বক্তব্য রেখেছেন এবং নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন ও পারিবারিক প্রেক্ষাপট

কনিকা বিশ্বাসের স্বামী ছিলেন বীরেন রাজ বিশ্বাস, যিনি নিজেও একজন সমাজকর্মী ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সহযোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের পরিবার রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ও সমাজসেবামূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল।

১৯৮৫ সালে বীরেন রাজ বিশ্বাসের মৃত্যু হলে কনিকা বিশ্বাস ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে কিছুটা দূরে সরে যান। তবে তিনি শিক্ষা ও মানবকল্যাণমূলক কাজে যুক্ত ছিলেন আজীবন।

ভারতে স্থায়ী বসবাস ও শেষ সময়ের জীবন

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও তাঁর পারিবারিক শিকড় ও আত্মীয়স্বজনের অনেকেই ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করতেন। বয়স বাড়ার পর কনিকা বিশ্বাসও পরিবারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার হৃদয়পুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।

সেখান থেকেই তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থেকে দুই বাংলার সাংস্কৃতিক সম্পর্ক জোরদারে কাজ করে গেছেন।

শেষ কয়েক বছর ধরে তিনি নানা বয়সজনিত রোগে ভুগছিলেন। পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় তিনি চিকিৎসা নিচ্ছিলেন কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে।

মৃত্যু ও শেষকৃত্য

কনিকা বিশ্বাসের আত্মীয় চিকিৎসক ডা. সুবোধ বিশ্বাস জানান, বুধবার বিকেলে কলকাতার সল্টলেকের মণিপাল হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বৃহস্পতিবার বিকেলে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হবে কলকাতার নিমতলা মহাশ্মশানে

তাঁর মৃত্যুতে রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ, স্থানীয় সংগঠন ও সাবেক সহকর্মীরা তাঁর অবদানের কথা স্মরণ করে শোক প্রকাশ করেছেন।

রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে তাঁর অবদান

কনিকা বিশ্বাস ছিলেন বাংলাদেশের নারী রাজনীতির পথিকৃৎদের একজন। এমন এক সময় তিনি রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন, যখন নারীদের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত ছিল। তিনি নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষার বিস্তার ও সমাজে নারীর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন।

তাঁর রাজনৈতিক জীবনে তিনি সবসময় বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, রাজনীতি মানে ক্ষমতা নয়—মানুষের সেবা করা।

সমকালীন রাজনীতিতে তাঁর শিক্ষা ও প্রভাব

বর্তমান প্রজন্মের নারী রাজনীতিকদের কাছে কনিকা বিশ্বাস এক অনুপ্রেরণার নাম। তাঁর জীবন, সংগ্রাম ও ত্যাগের গল্প নতুন প্রজন্মের কাছে নেতৃত্ব, সততা ও সাহসের উদাহরণ হয়ে থাকবে।

বিশেষ করে গ্রামের নারীদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণে তিনি যে উৎসাহ জুগিয়েছেন, তা বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বের বিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।

যে নারী জীবনের প্রতিটি ধাপে মানুষের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন, তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তাঁর আদর্শ, কর্মনিষ্ঠা ও দেশপ্রেম প্রজন্মের পর প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।

MAH – 13563 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button