চট্টগ্রামের বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে মো. সাজ্জাদ (২৫) নামের এক ছাত্রদল কর্মী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। এ ঘটনায় আরও অন্তত আটজন আহত হয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন।
ঘটনাটি ঘটেছে সোমবার দিবাগত মধ্যরাতে, অর্থাৎ ২৮ অক্টোবরের প্রথম প্রহরে। রাতের নীরবতা ভেঙে গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো বাকলিয়া এলাকা। এলাকাবাসীর মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, রাস্তায় যান চলাচলও সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে পড়ে।
ঘটনার সূত্রপাত: ব্যানার অপসারণ নিয়ে উত্তেজনা
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে বাকলিয়া এলাকায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে রাজনৈতিক আধিপত্য নিয়ে বিরোধ চলছিল। একপক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন স্থানীয় বিএনপি নেতা মো. কামরুল হোসেন, অন্যপক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন আরেক প্রভাবশালী নেতা নাছির উদ্দিন।
সম্প্রতি আসন্ন দলীয় কর্মসূচি ও পদ বণ্টন নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করে। সোমবার রাতে একটি রাজনৈতিক ব্যানার সরানোকে কেন্দ্র করে কথাকাটাকাটির জেরে শুরু হয় হাতাহাতি, পরে তা রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে রূপ নেয়।
চোখের পলকে দুই পক্ষের শতাধিক কর্মী লাঠি, রড, দা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে একে অপরের ওপর হামলা চালায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই এলাকায় গুলির শব্দে চারদিক থমথমে হয়ে ওঠে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান সাজ্জাদ
সংঘর্ষ চলাকালে ছাত্রদলের সক্রিয় কর্মী মো. সাজ্জাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
হাসপাতালের পুলিশ বক্সের ইনচার্জ (ASI) আলাউদ্দিন জানান, “রাত আড়াইটার দিকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এক যুবককে আনা হয়। পরে চিকিৎসক নিশ্চিত করেন যে তিনি মারা গেছেন। আহত অবস্থায় আরও আটজন ভর্তি হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।”
আহতদের পরিচয় ও চিকিৎসা
চমেক হাসপাতালে ভর্তি আহতদের মধ্যে রয়েছেন—
১. রাকিবুল ইসলাম (২৪)
২. নাজিম উদ্দিন (২৬)
৩. হাসান কামাল (২৩)
৪. মিজানুর রহমান (২৫)
৫. সাদ্দাম হোসেন (২৭)
৬. তানভীর আহমেদ (২২)
৭. মঈনুল ইসলাম (২৮)
৮. রুবেল মিয়া (২৪)
তাদের মধ্যে অন্তত তিনজনের অবস্থা গুরুতর বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। আহতদের মাথা, বুকে ও পায়ে গুলির চিহ্ন রয়েছে।
পুলিশের অবস্থান ও তদন্তের অগ্রগতি
বাকলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন,
“তুচ্ছ একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়েছে। এতে একজন মারা গেছেন এবং কয়েকজন আহত হয়েছেন। আমরা এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করেছি এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সংঘর্ষে কারা অস্ত্র ব্যবহার করেছে তা তদন্ত করা হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত কোনো পক্ষ মামলা করেনি, তবে আমরা প্রাথমিকভাবে কয়েকজনকে চিহ্নিত করেছি।”
এদিকে পুলিশ জানিয়েছে, সংঘর্ষে ব্যবহৃত অস্ত্র উদ্ধারের জন্য এলাকায় অভিযান চলছে। আশেপাশের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করা যায়।
স্থানীয়দের অভিমত: ‘রাজনৈতিক আধিপত্যের জেরেই রক্তপাত’
স্থানীয় এক দোকানদার বলেন, “আমরা বহুদিন ধরে দেখছি, এলাকায় বিএনপির দুই দলে দ্বন্দ্ব চলছে। কে এলাকাটা দখল করে রাখবে, কে পোস্টার দেবে— এসব নিয়েই সব সময় ঝগড়া হয়। এবার সেটা ভয়াবহ রূপ নিল।”
অন্য এক বাসিন্দা জানান, “রাত ১টার দিকে হঠাৎ গুলি চলতে থাকে। আমরা সবাই ঘরের ভেতরে আশ্রয় নিই। সকাল পর্যন্ত বাইরে বের হইনি।”
চট্টগ্রামে রাজনৈতিক সংঘর্ষের ইতিহাস
চট্টগ্রাম শহর দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে আলোচনায় থাকে। বিশেষ করে নগরীর বাকলিয়া, চান্দগাঁও, বন্দর ও হালিশহর এলাকায় প্রায়ই দলীয় কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
স্থানীয় রাজনীতিবিদরা মনে করেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাব, সংগঠনের ভিতরে মতবিরোধ এবং নেতৃত্বের লড়াই এই ধরনের সংঘর্ষের মূল কারণ। বিশেষ করে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নজরদারির অভাবে তৃণমূল পর্যায়ে দণ্ডায়মান গ্রুপগুলো প্রায়ই সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে।
বিএনপি নেতাদের প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“এই ধরনের সংঘর্ষ দলের ভাবমূর্তি নষ্ট করছে। আমরা চাই, সংগঠনের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা হোক। যেসব নেতাকর্মী এমন ঘটনায় জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
অন্যদিকে ছাত্রদল চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি বলেন,
“আমরা সাজ্জাদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করছি। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী কর্মী ছিলেন। দলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণে এমন মর্মান্তিক ঘটনা মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এর সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের কঠোর শাস্তি চাই।”
মরদেহের ময়নাতদন্ত ও পরবর্তী ব্যবস্থা
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নিহত সাজ্জাদের মরদেহ ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। তার পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালের মর্গে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সাজ্জাদের বড় ভাই বলেন,
“আমার ভাই রাজনীতি করত, কিন্তু সে কখনও সহিংসতায় ছিল না। তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে।”
তদন্তে কী বেরিয়ে আসতে পারে
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, এই সংঘর্ষ পরিকল্পিত হতে পারে। পূর্বপরিকল্পিতভাবে এলাকায় উত্তেজনা সৃষ্টি করে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করা হয়েছে কিনা, তা তদন্ত করা হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ADC) মাহবুবুল আলম জানান,
“আমরা সংঘর্ষের ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করছি। কারা অস্ত্র এনেছে, কারা প্রথমে গুলি চালিয়েছে— সব কিছু যাচাই করা হচ্ছে। দোষীরা যতই প্রভাবশালী হোক, ছাড় দেওয়া হবে না।”
এলাকায় শোক ও উত্তেজনা
সাজ্জাদের মৃত্যুর পর বাকলিয়া এক্সেস রোড এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। তার সহপাঠী ও বন্ধুরা হাসপাতালের সামনে জড়ো হয়ে ন্যায়বিচারের দাবিতে স্লোগান দিচ্ছেন।
তবে পুলিশ জানিয়েছে, যাতে পরিস্থিতি আবারও উত্তপ্ত না হয়, সে জন্য এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন করা হয়েছে।
সামাজিক প্রভাব ও বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বাংলাদেশে তৃণমূল পর্যায়ের রাজনৈতিক সহিংসতা দিন দিন বাড়ছে। স্থানীয় পর্যায়ে নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াই সাধারণ মানুষের জীবন বিপন্ন করছে।
চট্টগ্রামের এই ঘটনা শুধু একটি এলাকার সমস্যা নয়— এটি দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি প্রতিচ্ছবি। জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক নেতারা যেন অহিংস ও সহনশীল রাজনীতির চর্চা করেন।
চট্টগ্রামের বাকলিয়া এলাকার এই সংঘর্ষ আবারও প্রমাণ করলো, দলীয় অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব কতটা ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে। এক তরুণ ছাত্রদল কর্মীর প্রাণ হারানো শুধু একটি পরিবার নয়, পুরো সমাজের জন্যই একটি শোকাবহ বার্তা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের বিচারের মুখোমুখি করা, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
MAH – 13509 I Signalbd.com



