বাংলাদেশ

‘বড় সন্তানকে বের করতে পেরেছি, ছোটটাকে খুঁজে পাচ্ছি না’

Advertisement

 উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ ও নিখোঁজ বহু শিক্ষার্থী। সন্তানদের সন্ধানে ক্যাম্পাসে ছুটে এসেছেন শত শত মা-বাবা। কেউ সন্তানকে উদ্ধার করতে পেরেছেন, কেউ এখনো অজানায় অপেক্ষা করছেন।

ঘটনাস্থলে আহাজারি, উৎকণ্ঠায় শিক্ষার্থীদের পরিবার

রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ায় তৈরি হয়েছে চরম আতঙ্ক ও হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি। সোমবার দুপুরে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানজুড়ে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা, আহত হয়েছেন বহু শিক্ষার্থী। দুর্ঘটনার পর স্কুলের মূল ফটকে জড়ো হয়েছেন শত শত অভিভাবক, যাঁরা সন্তানদের খোঁজে দিশেহারা।

ঘটনাস্থলে থাকা লাকি আক্তার নামের এক মা বলেন,
“বড় সন্তানকে বের করতে পেরেছি, ছোটটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। ওর খোঁজে বারবার স্কুল চত্বর ঘুরছি, হাসপাতালেও খুঁজেছি।”

এই একবাক্য যেন তুলে ধরেছে শতাধিক অভিভাবকের ভয় আর অসহায়ের চিত্র। অনেকের মোবাইল বন্ধ, কেউ সন্তানকে বার্ন ইউনিটে পেয়েছেন, কেউ এখনও জানতে পারছেন না — সন্তান বেঁচে আছে কি না।

কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা

সোমবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইলস্টোন স্কুলের দোতলা একটি ভবনের সামনে বিধ্বস্ত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বিকট শব্দে বিস্ফোরণের পরপরই আগুন ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভবনজুড়ে। ভবনটিতে তখন ক্লাস চলছিল। বিশেষ করে প্রাথমিক শাখার তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা কক্ষে অবস্থান করছিল।

প্রাথমিক সূত্রে জানা যায়, বিমানটি প্রথমে কাছাকাছি একটি প্রজেক্ট ভবনে ধাক্কা খেয়ে জ্বালানি লিক করে এবং পরে গিয়ে স্কুল ভবনের সামনে আছড়ে পড়ে। এতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

আহত ও নিখোঁজ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা

ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এখন পর্যন্ত দগ্ধ অবস্থায় ২৮ জনকে নেওয়া হয়েছে। কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। পাশাপাশি, সিএমএইচসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে আরও অনেককে।

অনেক শিক্ষার্থী এখনো নিখোঁজ। তাঁদের পরিবার স্কুল চত্বর থেকে হাসপাতালে, আবার হাসপাতাল থেকে স্কুলে ছুটে চলেছেন। এখনো অনেকের পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, ফলে উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে।

নিখোঁজ সন্তানকে খুঁজে ফিরছেন মা-বাবারা

ঘটনার পরপরই স্কুলের গেট বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং উদ্ধারকাজ শুরু করে সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করছে। অভিভাবকরা বারবার অনুরোধ করলেও স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে সবাইকে সন্তানের অবস্থান জানানো সম্ভব হয়নি।

ফেরদৌসী বেগম নামের এক মা বলেন,
“আমার মেয়ে ভেতরে আটকে ছিল। ফোন বন্ধ। স্কুল কর্তৃপক্ষ কিছু বলতে পারছে না। শুধু বলছে, ‘সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।’ কীভাবে অপেক্ষা করব?”

তাঁর চোখের কোণে শুকনো অশ্রু, তবে গলার কণ্ঠস্বর ভারী।

স্কুল কর্তৃপক্ষের নীরবতা ও নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ

বিমানের মতো ঝুঁকিপূর্ণ প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের পাশে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন? কেনো দুর্ঘটনার আগমুহূর্তে কোনো সতর্ক সংকেত দেওয়া হয়নি? অভিভাবকদের এমন অসংখ্য প্রশ্নে আজ জর্জরিত স্কুল কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন।

মাইলস্টোন কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. সবুজ মিয়া জানান,
“বেলা ১টার দিকে ক্লাস শেষ হয়েছিল। অনেকে বেরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু অনেকেই অভিভাবকের জন্য অপেক্ষা করছিল। তখনই দুর্ঘটনাটি ঘটে।”

এই তথ্য থেকেই বোঝা যায়, আরও বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হয়নি, কারণ অনেক শিক্ষার্থী হয়তো ইতিমধ্যেই বেরিয়ে গিয়েছিল।

উদ্ধার তৎপরতা ও প্রশাসনের ভূমিকা

বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পরপরই এলাকায় পৌঁছে যায় উদ্ধারকারী দল। দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলে। সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস ও বিজিবি যৌথভাবে উদ্ধার কার্যক্রম চালায়। স্থানীয় বাসিন্দারাও সাহায্যে এগিয়ে আসেন।

তবে শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা, আহতদের অবস্থা ও পরিচয় জানাতে বিলম্ব হওয়ায় ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। অভিভাবকরা চাইছেন, দ্রুত সন্তানদের খোঁজ ও চিকিৎসার তথ্য জানানো হোক।

কীভাবে ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঠেকানো যায়

বিশেষজ্ঞদের মতে, জনবহুল এলাকায় বা স্কুলের আশেপাশে বিমান প্রশিক্ষণের মতো কার্যক্রম নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই দুর্ঘটনা ফের একবার সতর্ক করে দিল — নিরাপত্তা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস এখন সময়ের দাবি।

এভিয়েশন নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য,
“শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল বা জনবহুল স্থানে প্রশিক্ষণ বিমান না চালানোর নীতিমালা থাকা উচিত। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে নিয়মিত মেইনটেনেন্স, ফ্লাইট রুট পুনর্বিবেচনা ও স্থান নির্ধারণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।”

“বড় সন্তানকে বের করতে পেরেছি, ছোটটাকে খুঁজে পাচ্ছি না।”
— লাকি আক্তার, এক অভিভাবক

সারসংক্ষেপ  

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে আজকের এই দুর্ঘটনা শুধুই একটি বিমান বিধ্বস্তের খবর নয়। এটি শত শত পরিবারের কান্না, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার গল্প। সন্তানকে স্কুলে পাঠিয়ে যারা নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চায়, আজ তাদের সেই আস্থা চুরমার হয়েছে। এখন প্রশ্ন — নিরাপদ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কি শুধুই কাগজে-কলমে? প্রশাসনের কাছ থেকে অভিভাবকদের একটাই প্রত্যাশা — এ ঘটনার দায় কেউ যেন এড়িয়ে না যেতে পারে।

এম আর এম – ০৪৪৫, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button