বিএনপি মহাসচিবের অভিযোগ, “গণতন্ত্র ধ্বংস করেছে বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকার”
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, “জামায়াত ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নয়া দিগন্ত পত্রিকার মালিক মীর কাসেম আলী এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সাবেক সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ বহু আলেম-ওলামাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।”
শনিবার (২৫ অক্টোবর ২০২৫) রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমীতে দৈনিক নয়া দিগন্ত-এর ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
গণতন্ত্রকামীদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে আজকের ক্ষমতাসীনরা টিকে আছে”
মির্জা ফখরুল বলেন,
“আজকে যারা রাষ্ট্রের ক্ষমতায়, তারা গণতন্ত্রের শত্রু। গণতন্ত্রকামী মানুষের ওপর, বিএনপি ও ইসলামপন্থী নেতাদের ওপর যে দমন-পীড়ন চালানো হয়েছে—তা ইতিহাসে নজিরবিহীন।”
তিনি আরও যোগ করেন,
“৬০ লাখ কর্মীর নামে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে। ২০ হাজারের বেশি নেতা-কর্মী গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। এই সরকারের সময়ে দেশে কোনো নাগরিক নিরাপদ নয়।”
“নিজামী, মীর কাসেম, সালাউদ্দিন কাদেরসহ অনেককে মিথ্যা মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে”
বিএনপি মহাসচিব বলেন,
“জামায়াত ইসলামীর আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, নয়া দিগন্তের মালিক ও উদ্যোক্তা মীর কাসেম আলী, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অসংখ্য আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থী নেতাকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ইতিহাসে এটি একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।”
তিনি দাবি করেন,
“এই বিচারগুলো ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল। যেসব মামলায় প্রমাণের ঘাটতি ছিল, সেগুলোকেও ব্যবহার করা হয়েছে বিরোধী মতকে নিশ্চিহ্ন করতে।”
১৯৭৫ সালের বাকশাল যুগের পুনরাবৃত্তি দেখছেন ফখরুল
মির্জা ফখরুল বলেন,
“১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসন বাকশাল চালু করে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। সাংবাদিকরা তখন চাকরি হারিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন। অনেকেই হকারি করেছেন জীবিকা নির্বাহের জন্য।”
তিনি উল্লেখ করেন,
“সেই সময়ের মতোই এখনো সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হুমকির মুখে। সরকারের সমালোচনা করলেই মামলা, গ্রেপ্তার ও হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে সাংবাদিকদের।”
“জিয়াউর রহমান সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন”
বিএনপি মহাসচিব স্মরণ করেন,
“শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানই দেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনেন। তিনি বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর সময়েই বাংলাদেশে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ফিরে এসেছিল।”
তিনি বলেন,
“আজকে সেই স্বাধীনতা আবারও বিলীন হয়ে যাচ্ছে। যারা ভিন্নমত পোষণ করেন, তাদের জন্য এদেশে কোনো জায়গা নেই।”
“গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমেই বাংলাদেশ এগোবে”
মির্জা ফখরুল দৃঢ় কণ্ঠে বলেন,
“বাংলাদেশকে যদি সামনে এগিয়ে নিতে হয়, তবে অবশ্যই একটি গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রয়োজন। জনগণের ভোটেই জনগণের সরকার গঠন করতে হবে।”
তিনি বলেন,
“যদি সময়মতো নির্বাচন হয় এবং জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, তাহলেই আমরা প্রকৃত গণতন্ত্রে ফিরে যেতে পারব। অন্যথায় দেশ একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছে।”
“বিদেশি প্রভাবমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশ চাই”
বিএনপি মহাসচিব বলেন,
“আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যা কোনো বিদেশি শক্তির প্রভাবমুক্ত হবে। আমাদের দেশের সিদ্ধান্ত আমাদের জনগণই নেবে। স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য ছিল জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা—কিন্তু আজ তা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে।”
“দৈনিক নয়া দিগন্ত সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কাজ করছে”
নয়া দিগন্তের ২১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে মির্জা ফখরুল বলেন,
“দৈনিক নয়া দিগন্ত শুরু থেকেই সত্য, ন্যায় ও ইসলামী মূল্যবোধের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। প্রতিকূল সময়েও এই পত্রিকা গণমানুষের কণ্ঠস্বর তুলে ধরছে। আমি আশা করি, ভবিষ্যতেও এই ধারা অব্যাহত থাকবে।”
তিনি নয়া দিগন্তের সাংবাদিক, সম্পাদক, প্রকাশক ও পাঠকদের অভিনন্দন জানান।
অতীতের বিচার নিয়ে নতুন বিতর্ক
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, মির্জা ফখরুলের এই বক্তব্য বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও তার বিচার প্রক্রিয়াকে নতুনভাবে আলোচনায় এনেছে।
যদিও সরকার ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অনেকেই এই বিচারের ন্যায্যতা নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন।
২০১০ সালে শুরু হওয়া আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT-BD)-এর অধীনে মোট ৫০ জনেরও বেশি ব্যক্তির বিচার হয়, যাদের বেশিরভাগই বিএনপি ও জামায়াতের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন।
মতিউর রহমান নিজামী ও মীর কাসেম আলী ২০১৬ সালে ফাঁসিতে ঝুলেন। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ২০১৫ সালে।
বিএনপি ও জামায়াতের দাবি, এই বিচারগুলো ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, যার মাধ্যমে বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে।
অন্যদিকে সরকার দাবি করে, “এই বিচারগুলো ছিল মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের প্রতিকার ও ন্যায়বিচারের অংশ।”
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সমালোচনা
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল—তাদের একাধিক প্রতিবেদনে বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল।
তারা বলেছিল, সাক্ষ্য প্রমাণ সংগ্রহ ও প্রতিরক্ষা পক্ষকে পর্যাপ্ত সময় না দেওয়া, এ ধরনের অভিযোগ বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা নষ্ট করেছে।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে তখন বলা হয়, “এই বিচার ছিল আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সম্পন্ন। বিচার বিলম্বিত হলে ন্যায়বিচার ব্যাহত হতো।”
বর্তমান রাজনীতিতে তার প্রভাব
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে বিভক্তি এখনো বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ইস্যু।
একদিকে সরকার এটিকে ‘ন্যায়বিচারের প্রতীক’ হিসেবে তুলে ধরে, অন্যদিকে বিএনপি ও জামায়াত এটিকে ‘রাজনৈতিক প্রতিহিংসার হাতিয়ার’ বলে উল্লেখ করে।
এই বিতর্কের প্রভাব আজও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও নির্বাচনী পরিবেশে পরিলক্ষিত।
দেশে এখন গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে একদলীয় শাসন চলছে”
মির্জা ফখরুল বলেন,
“দেশে এখন গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসন চলছে। বিরোধী দলকে রাজনীতি করতে দেওয়া হচ্ছে না। সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে কোনো সৎ ও স্বচ্ছ নির্বাচন সম্ভব নয়।”
তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান—
“এই দুঃসময়ে গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনে সবাইকে একত্র হতে হবে। দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষাই আজকের সবচেয়ে বড় কাজ।”
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে—তিনি বর্তমান সরকারের বিচারব্যবস্থা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের অবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
তিনি দাবি করেছেন, “মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাসেম আলী ও সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীসহ অনেকের বিরুদ্ধে যে বিচার হয়েছে, তা ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।”
বাংলাদেশে এখন গণতন্ত্র, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও বিচারব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে—যা আগামী নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক অঙ্গনকে আরও উত্তপ্ত করে তুলতে পারে।
MAH – 13473 I Signalbd.com



