
তুরস্কের এসকিসেহির প্রদেশে ভয়াবহ দাবানল নেভাতে গিয়ে ১০ জন দমকলকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলাকালীন হঠাৎ দিক পরিবর্তনকারী বাতাসের কারণে তাঁরা আগুনের ফাঁদে আটকে পড়েন। এতে আরও অন্তত ১৪ জন আহত হয়ে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
দাবানলের তীব্রতা ও ঘটনাস্থল
দাবানলটি শুরু হয় এসকিসেহিরের সেয়িতগাজি জেলার পাহাড়ি এলাকায়, যেখানে মঙ্গলবার থেকে দমকল ও উদ্ধারকারী দল আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করছিল। বুধবার দুপুরে বাতাসের দিক আচমকা পাল্টে যাওয়ায় পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নেয়। আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বনাঞ্চলে, যেখানে ওই সময় ২৪ জন দমকলকর্মী আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
তুরস্কের কৃষি ও বনমন্ত্রী ইব্রাহিম ইউমাকলি জানিয়েছেন, আগুনের তীব্রতা এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে কর্মীরা পালানোর সুযোগ না পেয়ে আগুনে আটকে পড়েন।
নিহতদের পরিচয় ও আহতদের অবস্থা
নিহতদের মধ্যে পাঁচজন বন বিভাগের কর্মী এবং পাঁচজন উদ্ধারকর্মী ছিলেন। বাকি ১৪ জন গুরুতর দগ্ধ হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
প্রত্যক্ষদর্শী দমকলকর্মী এরকান টেমেল জানান, “ওরা পাহাড়ের ওপর কাজ করছিল। হঠাৎ করে বাতাসের দিক পাল্টে যায়, আগুন নিচ থেকে ওপরে ছুটে আসে। আমরা নিচে ছিলাম, ওরা ওপরে আটকে পড়ে। পালানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু পারেনি।”
সরকারি প্রতিক্রিয়া ও তদন্ত কার্যক্রম
দাবানলে প্রাণহানির ঘটনাটি নিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান। তিনি নিহতদের আত্মার শান্তি কামনা করে তাঁদের পরিবার ও জাতির প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন।
তুরস্কের বিচারমন্ত্রী ইয়েলমাজ তুনক জানিয়েছেন, ঘটনার প্রকৃত কারণ ও দায়ী কারও সংশ্লিষ্টতা নির্ধারণে ইতোমধ্যে দুটি প্রসিকিউটরকে তদন্তে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি লিখেছেন, “এই ভয়াবহ ঘটনার পূর্ণ তদন্ত হবে এবং যেকোনো গাফিলতি থাকলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জলবায়ুর প্রভাব
তুরস্কে দাবানলের ঘটনা এই প্রথম নয়। চলতি মাসের শুরুতেও ইজমিরের ওদেমিশ এলাকায় দাবানলে এক বৃদ্ধ ও দুই বনকর্মী প্রাণ হারান। এ ধরনের দাবানলের পেছনে বড় কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন, তীব্র তাপপ্রবাহ ও শুষ্ক আবহাওয়া।
গত কয়েকদিন ধরে তুরস্কের মধ্য ও পশ্চিমাঞ্চলে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি তাপমাত্রা বিরাজ করছে। তার সঙ্গে দমকা হাওয়া মিলে দাবানল দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। দেশটির আবহাওয়া বিভাগ সতর্ক করেছে, আগামী কয়েকদিন এই উচ্চ তাপমাত্রা ও খরা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকতে পারে।
দাবানলের বিস্তার ও সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে স্থানীয় বাসিন্দাদের
ইতোমধ্যে এসকিসেহিরসহ আশেপাশের আরও চারটি প্রদেশে মোট সাতটি পৃথক দাবানল জ্বলছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী ইউমাকলি। কিছু এলাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও, অধিকাংশ জায়গায় তা এখনও ছড়িয়ে পড়ছে।
বিভিন্ন গ্রাম থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিয়েছেন অনেকে। উদ্ধার কার্যক্রমে হেলিকপ্টার, ফায়ার ট্রাক এবং সেনাবাহিনীকেও যুক্ত করা হয়েছে।
সতর্কতা ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
কৃষি ও বনমন্ত্রী ইউমাকলি জানান, পরিস্থিতি এখনও ঝুঁকিপূর্ণ। তিনি জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান এবং বলেন, “আগামী কয়েকদিনে অস্বাভাবিক তাপমাত্রা এবং হঠাৎ ঝোড়ো হাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।”
তিনি আরও জানান, বন এলাকায় অপ্রয়োজনে প্রবেশ থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে এবং জরুরি পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
শেষ কথা
তুরস্কের এই দাবানল প্রমাণ করে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আগুন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকি কতটা বাড়ছে। যে দমকলকর্মীরা জীবন ঝুঁকি নিয়ে মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করেন, তাঁদের জন্য এ ধরনের বিপর্যয় চরম বেদনার।
তুরস্কে এমন প্রাণঘাতী দাবানল কবে শেষ হবে — এই প্রশ্ন এখন দেশটির প্রতিটি নাগরিকের মনে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে এই ধরনের বিপর্যয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকবে।
এম আর এম – ০৪৯৭ , Signalbd.com