
ইলিশ বিতরণের আলোচনা থামার আগেই আবারও আলোচনায় ফরিদপুর-৪ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী মাওলানা রায়হান জামিল। এবার তিনি ঘোষণা দিয়েছেন— মাত্র ১ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিতরণ করবেন ১০০টি অসহায় পরিবারে।
ঘোষণাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই শুরু হয়েছে নানা প্রতিক্রিয়া। কেউ প্রশংসা করছেন দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর এই উদ্যোগের, আবার কেউ বলছেন— “নির্বাচনের আগে এমন কাজ ভোট প্রভাবিত করার কৌশল।”
ইলিশ বিতরণ থেকে গরুর মাংস— আলোচনার ধারাবাহিকতা
এর আগে, চলতি বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর সদরপুর উপজেলায় রায়হান জামিল ঘোষণা দিয়েছিলেন— তিনি ১০ টাকা কেজিতে ইলিশ মাছ বিতরণ করবেন।
তবে সেদিনের ঘটনাটি শেষ পর্যন্ত বিতর্কে রূপ নেয়। স্থানীয়দের দাবি, বিতরণের সময় বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, অনেকে ইলিশ না পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রায়হান জামিল স্থান ত্যাগ করেন।
তবুও সেই বিতর্ক থামেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেই ঘটনার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কেউ বলেছেন, “এটি দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানোর এক মানবিক উদ্যোগ”, আবার কেউ এটিকে ভোটের লোভ দেখানোর প্রচেষ্টা বলেও সমালোচনা করেন।
এই ঘটনার এক মাস পেরোতেই এবার ১ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিতরণের ঘোষণা দিয়ে আবারও আলোচনায় এলেন রায়হান জামিল।
কবে ও কোথায় হবে বিতরণ
স্বতন্ত্র প্রার্থী মাওলানা রায়হান জামিল জানিয়েছেন, আগামী ৩০ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) তিনি ভাঙ্গা উপজেলার ১০০টি অসহায় ও হতদরিদ্র পরিবারের মধ্যে গরুর মাংস বিতরণ করবেন।
তিনি বলেন,
“আমি সবসময় চেষ্টা করি, আমার এলাকার গরিব মানুষের পাশে থাকতে। এবারও তাদের জন্য ছোট একটি উদ্যোগ নিয়েছি। টোকেনের মাধ্যমে তালিকা তৈরি করা হয়েছে— যেন প্রকৃত অসহায় মানুষরাই এই সাহায্য পান।”
যদিও ঠিক কোথায় এই বিতরণ অনুষ্ঠিত হবে তা পোস্টারে উল্লেখ করা হয়নি। তবে তার ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, এটি ভাঙ্গা উপজেলার সদর এলাকায় হতে পারে।
বিতরণের প্রক্রিয়া ও প্রস্তুতি
রায়হান জামিলের সমর্থকরা জানান, এই উদ্যোগটি “মানবিক সহায়তা” হিসেবে নেওয়া হয়েছে।
তারা বলেন, ১০০টি পরিবারের জন্য প্রায় ৮০ থেকে ১০০ কেজি গরুর মাংস প্রস্তুত রাখা হবে। প্রতিটি পরিবার পাবে ১ কেজি করে মাংস, আর প্রতীকী মূল্য হিসেবে ১ টাকা নেওয়া হবে।
এতে করে তারা আশা করছেন, “সহযোগিতার মর্যাদা” বজায় থাকবে, এবং মানুষ এটিকে ভিক্ষা নয়, অংশগ্রহণমূলক সহায়তা হিসেবে নেবে।
স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
ভাঙ্গা উপজেলা সদরের দোকানদার মো. আশরাফ আলী বলেন,
“মানুষ এখন কষ্টে আছে। বাজারে গরুর মাংসের দাম ৮০০-৯০০ টাকা কেজি। সেখানে ১ টাকায় মাংস দিলে এটা নিঃসন্দেহে দরিদ্রদের জন্য আশীর্বাদ।”
তবে স্থানীয় এক শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন,
“নির্বাচন সামনে রেখে এমন ঘোষণা জনগণের মনোযোগ কাড়ার একটা কৌশল হতে পারে। যদি সত্যিই মানবিক উদ্যোগ হয়, তাহলে তা প্রশংসার যোগ্য— তবে সময়টা প্রশ্ন তুলছে।”
পোস্টার ভাইরাল: সামাজিক মাধ্যমে তুমুল আলোচনা
ঘোষণার পরপরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ও এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ রায়হান জামিলের নতুন পোস্টার ছড়িয়ে পড়ে। পোস্টারে লেখা—
“অসহায় ও হতদরিদ্র জনগণের মধ্যে ১ টাকায় গরুর মাংস বিতরণ — উদ্যোগে মাওলানা রায়হান জামিল, স্বতন্ত্র প্রার্থী, ফরিদপুর-৪।”
অনেকেই পোস্টটি শেয়ার করে লিখেছেন,
“রাজনীতিতে যদি সবাই এমনভাবে দরিদ্রদের কথা ভাবত, সমাজটা বদলে যেত।”
অন্যদিকে কেউ কেউ লিখেছেন,
“এগুলো ভোটের আগে নাটক ছাড়া কিছু নয়।”
ফরিদপুর-৪ আসনে উত্তপ্ত নির্বাচন
ফরিদপুর-৪ (সদরপুর-ভাঙ্গা-চরভদ্রাসন) আসনটি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচিত।
এ আসনে এবারও বড় দুই দলের প্রার্থীর পাশাপাশি কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই আসনে ভোটের মাঠে গ্রামীণ জনসংযোগ, ধর্মীয় প্রভাব ও জনকল্যাণমূলক প্রচার বড় ভূমিকা রাখে।
সেই দিক থেকে রায়হান জামিলের এই ধরণের মানবিক প্রচারণা ভোটের মাঠে তাকে কিছুটা সুবিধা দেবে বলেও অনেকে মনে করছেন।
আইনি ও নৈতিক প্রশ্ন
নির্বাচন ঘনিয়ে এলে প্রার্থীদের এমন ‘উপহারমূলক কার্যক্রম’ প্রায়ই বিতর্ক তৈরি করে।
নির্বাচন কমিশনের নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে— ভোটের আগে প্রার্থী কোনো ধরণের আর্থিক প্রলোভন বা উপহার দিতে পারবেন না, যা ভোটারদের প্রভাবিত করতে পারে।
ভাঙ্গা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন,
“যদি কোনো প্রার্থী নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন, আমরা বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারি। তবে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি।”
জনকল্যাণ না প্রচারণা?
সমাজবিজ্ঞানী ড. হাবিবুল আলম বলেন,
“এমন কর্মকাণ্ডে দুই দিক থাকে। একদিকে এটি মানবিক উদ্যোগ, অন্যদিকে নির্বাচনী প্রচারণার অংশ। বিষয়টি নির্ভর করে উদ্দেশ্যের ওপর— প্রার্থী কি নিয়মিত এসব করেন, নাকি নির্বাচনের আগে হঠাৎ শুরু করেছেন।”
তিনি আরও বলেন,
“জনগণের সহায়তা অবশ্যই ভালো, কিন্তু যদি তা রাজনৈতিক স্বার্থে হয়, তাহলে সেটি নৈতিক প্রশ্ন তোলে।”
জনমতের বিশ্লেষণ
ভাঙ্গা ও আশপাশের এলাকায় কথা বলে জানা যায়, সাধারণ মানুষ বিষয়টিকে দুইভাবে দেখছেন।
কেউ মনে করছেন এটি দরিদ্রদের সহায়তা, আবার কেউ দেখছেন রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে।
তবে স্থানীয় তরুণরা বলছেন,
“রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা যদি এমন মানবিক কাজে রূপ নেয়, তাহলে সমাজের লাভই বেশি। মানুষ অন্তত কিছু পাচ্ছে।”
নির্বাচনী প্রচারণায় মানবিক ছোঁয়া
রায়হান জামিল এর আগেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য সাহায্য, বন্যার্তদের ত্রাণ বিতরণ ও মসজিদ সংস্কার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছিলেন।
তবে এবার তার এই ‘১ টাকায় মাংস বিতরণ’ ঘোষণা জাতীয় পর্যায়েও আলোচনা তৈরি করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন,
এটি একটি ‘মানবিক প্রচারণা কৌশল’, যা মানুষের মনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
ভাঙ্গার মানুষ এখন তাকিয়ে আছে ৩০ অক্টোবরের দিকে— রায়হান জামিল সত্যিই কি ১ টাকায় গরুর মাংস বিতরণ করবেন, নাকি এটি কেবল নির্বাচনী প্রচারণার অংশ?
সময়ই তা বলে দেবে। তবে ইতোমধ্যেই এই ঘোষণা সোশ্যাল মিডিয়া ও স্থানীয় রাজনীতির আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে।
MAH – 13425 I Signalbd.com