রাজনীতি

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বিকেলে এনসিপি ও সন্ধ্যায় জামায়াতের বৈঠক

Advertisement

বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হচ্ছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে আয়োজিত ধারাবাহিক সংলাপের মাধ্যমে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তিনি রাজনৈতিক ঐক্য, স্থিতিশীলতা ও গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথে সকল দলকে একত্রে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

আজ বুধবার বিকেল ৫টায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসবে ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনসিপি)-র প্রতিনিধিদল। দলের চেয়ারম্যান নাহিদ ইসলাম এই বৈঠকে দলের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন। একই দিন সন্ধ্যায় জামায়াতে ইসলামীর ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেবে আরেকটি বৈঠকে, যার নেতৃত্ব দেবেন দলটির নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের

বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য ও প্রেক্ষাপট:

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসন ও নির্বাচনের পূর্বপর্যায়ে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। গত কয়েক মাস ধরে নানা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, সহিংসতা ও পারস্পরিক অবিশ্বাসের প্রেক্ষাপটে এই সংলাপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

প্রধান উপদেষ্টা মনে করছেন— টেকসই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে হলে সকল দলের মতামত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। তাই বড় দলগুলো ছাড়াও মাঝারি ও ছোট দলগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গেও বৈঠক করছেন তিনি।

গতকাল বিএনপির সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক:

এর আগের দিন, অর্থাৎ মঙ্গলবার (২১ অক্টোবর), প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)
তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলে ছিলেন—

  • মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর,
  • স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এবং
  • সালাহউদ্দিন আহমেদ

বিএনপি’র পক্ষ থেকে তারা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা, নির্বাচন কমিশনের গঠন, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, এবং ভোটের পরিবেশ নিয়ে তাদের প্রস্তাব তুলে ধরেন।

সরকারের পক্ষ থেকে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন—

  • অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ (পরিকল্পনা উপদেষ্টা),
  • অধ্যাপক আসিফ নজরুল (আইন উপদেষ্টা),
  • এবং আদিলুর রহমান খান (শিল্প উপদেষ্টা)।

বৈঠকটি চলে প্রায় দেড় ঘণ্টা, এবং উভয় পক্ষই আলোচনার পর এটিকে “গঠনমূলক” বলে অভিহিত করেন।

এনসিপি’র প্রত্যাশা ও প্রস্তাবনা:

ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনসিপি) দেশের রাজনীতিতে তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও, দলটি বিভিন্ন জাতীয় ইস্যুতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে আসছে।
দলের চেয়ারম্যান নাহিদ ইসলাম জানান, “আমরা বিশ্বাস করি, জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি নতুন পথের সূচনা করতে পারে। আমরা চাই— নির্বাচনের পূর্বে সব পক্ষের অংশগ্রহণে একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামো গঠিত হোক।”

এনসিপি’র প্রতিনিধিদল আজকের বৈঠকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো উপস্থাপন করবে বলে জানা গেছে—

  • নির্বাচনকালীন প্রশাসনকে আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করা,
  • রাজনীতিতে সহনশীলতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা,
  • এবং দুর্নীতি ও অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া।

জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণের তাৎপর্য:

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীর বৈঠক অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও দলটি নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় পুনর্গঠনের চেষ্টা করছে।

জামায়াতের নায়েবে আমীর ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বৈঠকের আগে সাংবাদিকদের বলেন—

“আমরা বিশ্বাস করি, দেশের স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সংলাপই একমাত্র পথ। আমাদের দল গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে আগ্রহী।”

বিশ্লেষকদের মতে, জামায়াতের অংশগ্রহণ এই সংলাপ প্রক্রিয়াকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে। কারণ, দীর্ঘদিন পর এই দলটি প্রধান উপদেষ্টার সরাসরি আলোচনায় বসছে।

প্রধান উপদেষ্টার সংলাপ উদ্যোগ: পটভূমি ও অগ্রগতি

অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ড. ইউনূস দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন।
তিনি একাধিকবার বলেছেন—

“বাংলাদেশকে এখন ঐক্যের মাধ্যমে এগিয়ে নিতে হবে। কোনো দল বা মত নয়, জাতীয় স্বার্থই হবে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।”

তার নেতৃত্বে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, গণতান্ত্রিক পার্টি, ও বিভিন্ন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিটি বৈঠকেই আলোচ্য বিষয় ছিল— স্বচ্ছ নির্বাচন, গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, এবং শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশ

বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে বর্তমান সংলাপ প্রক্রিয়া:

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন এই সংলাপ প্রক্রিয়া দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত হয়ে থাকতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ফরিদ হোসেন বলেন—

“দীর্ঘ সময় ধরে যে অবিশ্বাসের দেয়াল তৈরি হয়েছিল, তা ভাঙতে এমন আলোচনাই প্রয়োজন। তবে সংলাপ শুধু আনুষ্ঠানিকতা না হয়ে বাস্তব ফল আনতে হবে।”

অন্যদিকে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন— জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে স্বচ্ছতা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, এবং প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ।

ভবিষ্যতের রোডম্যাপ: কোথায় যাচ্ছে সংলাপের পথ

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টা আগামী সপ্তাহেও আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এর মধ্যে রয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামিক ফ্রন্ট, ও কয়েকটি আঞ্চলিক রাজনৈতিক সংগঠন।

সব আলোচনা শেষে একটি সম্মিলিত রাজনৈতিক চুক্তি বা “জাতীয় ঐক্যঘোষণা” প্রকাশ করার সম্ভাবনাও রয়েছে, যাতে থাকবে—

  • নির্বাচনের রোডম্যাপ,
  • নির্বাচনী আচরণবিধি,
  • এবং সকল দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি।

জনমতের প্রতিক্রিয়া:

সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী, এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই সংলাপ উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হচ্ছে।
মিরপুরের ব্যবসায়ী মো. রাশেদ বলেন—

“রাজনীতিতে যদি সবাই মিলে কথা বলে সমাধান খোঁজে, তাহলে দেশের অর্থনীতি ভালো থাকবে। আমরা চাই শান্তি।”

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিতু আক্তার বলেন—

“আমরা চাই, সব দলের অংশগ্রহণে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। ড. ইউনূসের উদ্যোগটা যদি সফল হয়, সেটাই হবে সবচেয়ে বড় অর্জন।”

বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে শুরু হওয়া এই রাজনৈতিক সংলাপ প্রক্রিয়া যদি বাস্তব ফলাফল আনতে পারে, তাহলে দেশ আবারও একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক পথে ফিরতে পারবে।
আজকের এনসিপি জামায়াতের বৈঠক সেই যাত্রার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ— যা নির্ধারণ করবে দেশের আগামী রাজনীতির দিকনির্দেশ।

MAH – 13422 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button