রাজনীতি

চাকসুতে ভিপি-জিএসসহ ২৪টি পদে ছাত্রশিবিরের জয়

Advertisement

৪৪ বছর পর চাকসুর নেতৃত্বে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রত্যাবর্তন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে দীর্ঘ ৪৪ বছর পর ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ফিরে এসেছে ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’। বুধবার অনুষ্ঠিত ভোটে সংগঠনটির সমর্থিত প্যানেল ২৬টি পদের মধ্যে ২৪টি পদে জয় লাভ করেছে।
এই জয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচিত হলো। সর্বশেষ ১৯৮১ সালে চাকসুর ভিপি ও জিএস পদে জয়ী হয়েছিলেন ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থীরা।

শান্তিপূর্ণ ভোটগ্রহণে শিক্ষার্থীদের উৎসবমুখর অংশগ্রহণ

১৫ অক্টোবর বুধবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৪টি হল ও একটি হোস্টেলে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক, সাংবাদিক ও পর্যবেক্ষকরা জানিয়েছেন—দীর্ঘদিন পর এমন শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন ফলাফল ঘোষণা করেন।

ভিপি পদে মো. ইব্রাহিম হোসেন রনির জয়

ভাইস প্রেসিডেন্ট (ভিপি) পদে ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থী মো. ইব্রাহিম হোসেন রনি ৭ হাজার ৯৮৩ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন।
তিনি ইতিহাস বিভাগের এমফিল গবেষক ও ইসলামী ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম মহানগর দক্ষিণের সভাপতি।
রনির নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী সাজ্জাদ হোসেন, যিনি পেয়েছেন ৪ হাজার ৩৭৪ ভোট।

ভোট শেষে রনি বলেন,

“এ বিজয় শুধু একটি প্যানেলের নয়, এটি পুরো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস ও পরিবর্তনের আহ্বানের প্রতিফলন। আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, চাকসুকে শিক্ষার্থীদের কল্যাণে কাজ করার মঞ্চে পরিণত করব।”

জিএস পদে সাঈদ বিন হাবিবের বিজয়

সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ‘সম্প্রীতি’ প্যানেলের সাঈদ বিন হাবিব ৮ হাজার ৩১ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সাহিত্য সম্পাদক এবং ইতিহাস বিভাগের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী।
নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী মো. শাফায়াত পেয়েছেন ২ হাজার ৭৩৪ ভোট।

জয়ের পর হাবিব বলেন,

“চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাঙ্গন। আমরা চাই, চাকসু এমন এক প্ল্যাটফর্ম হোক যেখানে সকল মত ও পথের শিক্ষার্থীরা সম্মানের সঙ্গে অংশ নিতে পারে।”

এজিএস পদে জয়ী ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী

সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে একমাত্র ছাত্রদল সমর্থিত প্রার্থী আইয়ুবুর রহমান তৌফিক জয় পেয়েছেন।
তিনি পেয়েছেন ৭ হাজার ১৪ ভোট, আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন শিবির সমর্থিত সাজ্জাদ হোসেন, যিনি পেয়েছেন ৫ হাজার ৪৫ ভোট।

নারী নেতৃত্বেও নতুন ইতিহাস

চাকসুর সহ-খেলাধুলা ও ক্রীড়া সম্পাদক পদে বিজয়ী হয়েছেন সম্প্রীতি প্যানেলের একমাত্র নারী প্রার্থী তামান্না মাহবুব
তিনি বলেছেন,

“আমি বিশ্বাস করি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা এখন আরও বেশি আত্মবিশ্বাসী হবে। এই জয় নারী নেতৃত্বের অগ্রযাত্রার প্রতীক।”

নির্বাচনে উত্তেজনা ও প্রশাসনের ভূমিকা

যদিও সারাদিনের ভোট শান্তিপূর্ণ ছিল, ফলাফল ঘোষণার আগে কিছু উত্তেজনা দেখা দেয়।
বুধবার রাত একটার পর ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিনকে অবরুদ্ধ করে রাখেন।
রাত সাড়ে ৩টার দিকে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং তিনি মুক্ত হন।

পরে ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য বিজিবি মোতায়েন করা হয়।
তবে কোনো সংঘর্ষ বা বড় ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যায়নি।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনির উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন,

“এটি একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ কিন্তু শান্তিপূর্ণ নির্বাচন ছিল। শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত পরিপক্বতা ও শৃঙ্খলার সঙ্গে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছে।”

৪৪ বছরের বিরতিতে ফিরে আসা নেতৃত্ব

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৮১ সালে।
সে সময় ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত প্রার্থী জসিম উদ্দিন সরকার ভিপি ও আবদুল গাফফার জিএস নির্বাচিত হয়েছিলেন।
এরপর নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা, প্রশাসনিক জটিলতা ও সহিংসতার কারণে দীর্ঘ সময় ধরে চাকসু নির্বাচন বন্ধ ছিল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষকরা মনে করেন,
এই নির্বাচন শুধু ছাত্ররাজনীতির পুনর্জাগরণ নয়, বরং শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক চর্চার প্রত্যাবর্তনের প্রতীক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে নতুন ভারসাম্য

বিশ্লেষকদের মতে, ইসলামী ছাত্রশিবিরের এই জয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিতে একটি নতুন ভারসাম্য সৃষ্টি করবে।
গত কয়েক বছর ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের প্রভাব ছিল উল্লেখযোগ্য।
তবে এবার দীর্ঘদিনের নিষ্ক্রিয় শিবির পুনরায় সক্রিয় হয়ে শক্তিশালী সংগঠক হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে।

একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন,

“এই নির্বাচনের ফলাফল শুধু চাকসু নয়, দেশের ক্যাম্পাস রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে।
৪৪ বছর পর ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ফিরে আসা তাদের সাংগঠনিক সক্ষমতার স্পষ্ট ইঙ্গিত।”

শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া

চাকসুর নির্বাচনে অংশ নেওয়া বিভিন্ন বর্ষের শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, তারা এবার ভোট দিতে পেরে গর্বিত।
প্রথম বর্ষের ছাত্রী সোনিয়া ইসলাম বলেন,

“আমাদের সিনিয়ররা বলতেন, চাকসু শুধু বইয়ের পাতায় দেখা যায়। কিন্তু এবার সরাসরি ভোট দিতে পারলাম—এটাই সবচেয়ে আনন্দের।”

চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী রাকিবুল হাসান বলেন,

“এমন প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন অনেক বছর পর দেখলাম। আশা করি, নতুন নেতৃত্ব শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো সমাধানে আন্তরিক হবে।”

প্রশাসনের বক্তব্য

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীন আখতার বলেন,

“বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশেষে গণতান্ত্রিক চর্চা ফিরে এসেছে। আমরা আশা করি, নবনির্বাচিত প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের একতা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখবেন।”

তিনি আরও জানান,

“নির্বাচন প্রক্রিয়ায় সকল পক্ষের সহযোগিতা ছিল প্রশংসনীয়। প্রশাসন ভবিষ্যতেও ছাত্রসংসদের কার্যক্রমে সহায়তা করবে।”

নির্বাচনী ফলাফলের সংক্ষিপ্ত বিবরণ

পদবিজয়ীসমর্থনভোট সংখ্যা
ভিপিমো. ইব্রাহিম হোসেন রনিইসলামী ছাত্রশিবির৭,৯৮৩
জিএসসাঈদ বিন হাবিবইসলামী ছাত্রশিবির৮,০৩১
এজিএসআইয়ুবুর রহমান তৌফিকছাত্রদল৭,০১৪
সহ-খেলাধুলা সম্পাদকতামান্না মাহবুবইসলামী ছাত্রশিবিরজয়ী
অন্যান্য ২২ পদসম্প্রীতি প্যানেলইসলামী ছাত্রশিবিরজয়ী

চাকসুর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ও প্রত্যাশা

নবনির্বাচিত কমিটি জানিয়েছে, তারা প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ কিছু বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নেবে।
এর মধ্যে রয়েছে—

  • ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়ন
  • শিক্ষার্থীদের জন্য স্টুডেন্ট কার্ড ও অনলাইন ফিডব্যাক সিস্টেম
  • কোর্স রেজিস্ট্রেশন সহজীকরণ
  • শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে মেডিকেল ইউনিট সম্প্রসারণ
  • গ্রন্থাগার সময়সীমা বৃদ্ধি ও ডিজিটাল রিসোর্স অ্যাক্সেস

ভিপি রনি জানান,

“আমরা চাই, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হোক এমন এক শিক্ষাঙ্গন যেখানে জ্ঞান, নীতি ও ঐক্য—এই তিনটি মূল্যবোধের সমন্বয়ে শিক্ষার্থীরা বেড়ে উঠবে।”

৪৪ বছর পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতিতে ফিরে এসেছে এক ঐতিহাসিক অধ্যায়।
ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ‘সম্প্রীতি’ প্যানেলের এই জয় কেবল একটি সংগঠনের সাফল্য নয়, বরং ক্যাম্পাস রাজনীতিতে নতুন দিকনির্দেশনার সূচনা।
শিক্ষার্থীরা আশা করছে, এই নতুন নেতৃত্ব চাকসুকে আবারও তাদের অধিকার ও অংশগ্রহণের প্রকৃত মঞ্চে রূপান্তরিত করবে।

MAH – 13338 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button