
৩৫ বছর পর চাকসু ভোটে নতুন বিতর্ক – অমোচনীয় কালি নিয়েই প্রশ্ন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু প্রতীক্ষিত কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু), হল ও হোস্টেল সংসদ নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা ও উচ্ছ্বাসের পাশাপাশি এখন দেখা দিয়েছে নতুন এক বিতর্ক। ভোটের সময় শিক্ষার্থীদের আঙুলে ব্যবহৃত কালি অল্প সময়েই মুছে যাচ্ছে—এমন অভিযোগ তুলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন দলের শিক্ষার্থী এবং প্রার্থী।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান অভিযোগ করেছেন, ভোটদাতাদের হাতে দেওয়া কালি কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুছে যাচ্ছে, যা ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন তুলছে।
তিনি বলেন,
“নির্বাচনের আগে আমাদের বলা হয়েছিল, অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হবে—যা অন্তত ২৪ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, কয়েক মিনিট ঘষলেই কালি মুছে যাচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব? আমরা এই বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ জানাব।”
শিক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা: ‘ভোট দিলেও কেউ প্রমাণ করতে পারবে না’
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী ইমরান রায়হান বলেন,
“আমি নিজে ভোট দিয়েছি মাত্র কয়েক মিনিট আগে। কিন্তু এখন আঙুলের দিকে তাকালে কেউ বলতে পারবে না যে আমি ভোট দিয়েছি। একটু ঘষলেই কালি উঠে যাচ্ছে। এটা ভোটের নিরাপত্তার জন্য উদ্বেগজনক।”
এই একই অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আরও অনেকে। কেউ কেউ বলেছেন, কালি মুছে যাওয়ায় একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে, যা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
প্রার্থীদের প্রতিক্রিয়া: কমিশনের জবাব চাই
দ্রোহ পরিষদের ভিপি (সহসভাপতি) প্রার্থী ঋজু লক্ষ্মী অবরোধ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“নির্বাচন কমিশন অফিস থেকে আমাদের বারবার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে অমোচনীয় কালি ব্যবহার করা হবে। কিন্তু আজ ভোট দিয়ে এসে দেখছি, কালি তো একদমই টিকছে না। আমার নিজের আঙুলের কালি ঘষে মুছে ফেললাম। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি আরও বলেন,
“এই ঘটনায় প্রমাণ হয় যে নির্বাচন কমিশন পুরোপুরি প্রস্তুত ছিল না। ৩৫ বছর পর হওয়া চাকসু নির্বাচনের এমন অনিয়ম শিক্ষার্থীদের আস্থাকে নষ্ট করছে।”
নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য এখনো আসেনি
এই বিষয়ে জানতে চাইলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কমিশনের কোনো কর্মকর্তা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাননি। তবে অনানুষ্ঠানিকভাবে কমিশনের এক সদস্য জানিয়েছেন,
“কালি সরবরাহের দায়িত্ব ছিল সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক দপ্তরের। হয়তো সরবরাহকৃত কালি মানসম্মত ছিল না। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তবে ছাত্র সংগঠনগুলো মনে করছে, এ ধরনের অজুহাতের মাধ্যমে কমিশন দায়িত্ব এড়াতে চাচ্ছে। তাদের দাবি—অমোচনীয় কালি ব্যবহারের নিশ্চয়তা দেওয়া হলেও বাস্তবে তা মানা হয়নি।
৩৫ বছর পর চাকসু নির্বাচন: শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ছিল উঁচু
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচন হচ্ছে ৩৫ বছর পর। দীর্ঘ এই বিরতির পর শিক্ষার্থীরা আশা করছিলেন একটি উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচন।
নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরু হয় সকাল ৮টায়, যা চলবে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। এবারই প্রথমবারের মতো ওএমআর ব্যালট পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি অনুষদ ভবনে মোট ১৫টি ভোটকেন্দ্র এবং ৬১টি ভোটকক্ষ স্থাপন করা হয়েছে।
চাকসুর ২৬টি পদের জন্য লড়ছেন ৪১৫ জন প্রার্থী, আর হল ও হোস্টেল সংসদের ২৪টি পদের জন্য প্রার্থী হয়েছেন ৪৯৩ জন। মোট ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৬ জন।
ভোটের দিন: শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শুরু, কিন্তু অভিযোগ বাড়ছে
ভোর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ছিল নির্বাচনী উচ্ছ্বাস। বিভিন্ন সংগঠনের সমর্থকরা ভোটারদের আহ্বান জানাচ্ছিলেন ভোট কেন্দ্রে যেতে। ক্যাম্পাসজুড়ে ছিল পোস্টার, ব্যানার ও প্রচারণার স্লোগান।
তবে দুপুরের পর থেকেই কালি মুছে যাওয়ার অভিযোগ ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়। কেউ কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় আঙুলের ছবি পোস্ট করে বিষয়টি তুলেন ধরেন। ফেসবুক ও এক্স (টুইটার)-এ “#চাকসু_কালি_বিতর্ক” নামে ট্রেন্ড শুরু হয়েছে।
বিশ্লেষকরা যা বলছে
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মাহমুদুল হাসান মনে করেন,
“৩৫ বছর পর যখন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনরায় চালু হলো, তখন এমন অভিযোগ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। প্রশাসনের উচিত বিষয়টি অবিলম্বে তদন্ত করা।”
তিনি বলেন,
“অমোচনীয় কালি না থাকলে একাধিকবার ভোট দেওয়ার সুযোগ তৈরি হতে পারে। এর ফলে নির্বাচনের ফলাফল নিয়েও বিতর্ক দেখা দিতে পারে।”
ছাত্রদলের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদল জানিয়েছে, তারা এই বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেবে। তারা দাবি করেছে,
“এই অনিয়ম শুধু কালি মুছে যাওয়ায় সীমাবদ্ধ নয়—বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের পোস্টার ও ব্যানার সরানো হয়েছে।”
ছাত্রদল নেতা আবদুল্লাহ আল নোমান বলেন,
“আমরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি গণতন্ত্রের চর্চা বজায় রাখার জন্য। কিন্তু যদি প্রশাসন ও কমিশন নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে শিক্ষার্থীদের আস্থা পুনর্গঠন সম্ভব হবে না।”
অন্যান্য সংগঠনের প্রতিক্রিয়া
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের এক নেতার দাবি,
“কালি সংক্রান্ত অভিযোগ ভিত্তিহীন। কেউ হয়তো ভুলভাবে কালি ঘষেছেন। এতে নির্বাচন প্রভাবিত হবে না।”
তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বলছেন, অভিযোগের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন,
“এটা ছোট কোনো বিষয় নয়। শিক্ষার্থীদের আঙুলে দেওয়া কালি মুছে গেলে নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
চাকসু নির্বাচনের ঐতিহাসিক পটভূমি
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকসু নির্বাচন সর্বশেষ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে। এরপর বিভিন্ন প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক কারণে দীর্ঘদিন এটি বন্ধ ছিল।
চাকসু হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ শিক্ষার্থী প্রতিনিধি পরিষদ, যা শিক্ষার্থীদের নীতি, অধিকার, সংস্কৃতি ও কল্যাণমূলক কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেয়। তাই এই নির্বাচন শিক্ষার্থীদের কাছে শুধু ভোট নয়—একটি গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের প্রতীক।
ভোটের প্রযুক্তি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা
এবারের নির্বাচনে ব্যবহৃত হচ্ছে আধুনিক ওএমআর (Optical Mark Recognition) ব্যালট সিস্টেম, যা কাগজে চিহ্নিত ভোটকে যন্ত্রের মাধ্যমে গণনা করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই পদ্ধতিতে ফলাফল দ্রুত ও নির্ভুলভাবে পাওয়া যাবে।
ভোটকেন্দ্রগুলোতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী ছাড়াও জেলা পুলিশের সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। পুরো ক্যাম্পাসে ছিল শান্তিপূর্ণ পরিবেশ, যদিও দুপুরের পর কালি-সংক্রান্ত বিতর্কে উত্তেজনা দেখা দেয়।
সামাজিক মাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া মিশ্র। কেউ প্রশাসনকে দোষ দিচ্ছেন, কেউ বলছেন এটি “প্রযুক্তিগত ত্রুটি।”
একজন শিক্ষার্থী লিখেছেন,
“৩৫ বছর পর আমরা ভোট দিতে পেরেছি, এটা আনন্দের। কিন্তু এমন ত্রুটিতে আনন্দটা ম্লান হয়ে গেল।”
আরেকজন মন্তব্য করেছেন,
“যদি কালি সত্যিই মুছে যায়, তাহলে এটা বড় অনিয়ম। কমিশনের জবাব জরুরি।”
আগামী করণীয়
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানিয়েছে, নির্বাচন শেষ হওয়ার পর এই অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি দেখা যায় কালি মানসম্মত ছিল না, তাহলে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।
নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করা হবে আজ রাতেই। শিক্ষার্থীরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন কারা দায়িত্বে আসবেন নতুন চাকসুতে।
MAH – 13328 I Signalbd.com