রাজনীতি

দুর্গাপূজার মণ্ডপে পুলিশের ওপর হামলা, ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা

Advertisement

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় দুর্গাপূজার মণ্ডপে ডিজে সাউন্ড সিস্টেমের উচ্চস্বরে গান বাজানোকে কেন্দ্র করে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়কসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। তবে মামলার পরও এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি।

ঘটনার বিস্তারিত

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সোমবার (২৯ সেপ্টেম্বর) দিবাগত রাত প্রায় ১টার দিকে উল্লাপাড়া পৌরসভার ভবানী মন্দির এলাকায় দুর্গাপূজার মণ্ডপে সাউন্ড সিস্টেমে উচ্চস্বরে ডিজে গান বাজানো হচ্ছিল। পুলিশ সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হয়ে শব্দ কমানোর অনুরোধ করলে উপস্থিত কয়েকজন যুবক ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তারা পুলিশের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে এবং একপর্যায়ে হামলা চালায়।

এ সময় দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল সাগর আহমেদ আহত হন। ঘটনার সময় থানার এএসআই মো. ওমর ফারুকসহ অন্যান্য পুলিশ সদস্য, আনসার ভিডিপি সদস্য এবং স্থানীয় লোকজনও সেখানে ছিলেন। তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলেও পরে উল্লাপাড়া সার্কেল অফিসার এবং থানার ওসি ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

পুলিশের বক্তব্য

উল্লাপাড়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রাকিবুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, “এ ঘটনায় এএসআই ওমর ফারুক বাদী হয়ে ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেছেন। তবে এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। আমরা তদন্ত অব্যাহত রেখেছি।”

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (উল্লাপাড়া সার্কেল) শরাফত আলী বলেন, “আমরা পূজার নিরাপত্তা নিয়েই ব্যস্ত আছি। ঘটনা তদন্ত চলছে। সময়মতো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

মামলার আসামিদের নাম

মামলায় আসামিদের মধ্যে রয়েছেন—

  • সিরাজগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম
  • সিরাজগঞ্জ মোটর মালিক গ্রুপের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য ইখতিয়ার উদ্দিন
  • স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হাফিজসহ মোট ১৮ জন

তবে মামলা হওয়ার পরও কাউকে গ্রেপ্তার না করায় স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

আসামিদের প্রতিক্রিয়া

প্রধান আসামি সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। ফলে তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

দুর্গাপূজা চলাকালে নিরাপত্তা ব্যবস্থা

বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা চলাকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সবসময় বিশেষ সতর্ক অবস্থায় থাকে। প্রতিটি জেলা ও উপজেলার পূজা মণ্ডপে পুলিশ, র‍্যাব এবং আনসার ভিডিপি সদস্য মোতায়েন করা হয়।

এবারের দুর্গাপূজা উপলক্ষে সরকার আগেই জানিয়েছিল, সারা দেশে ৩০ হাজারের বেশি মণ্ডপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা, মেটাল ডিটেক্টর ও প্রবেশপথে তল্লাশি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

এর মধ্যেই সিরাজগঞ্জে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও কীভাবে এমন ঘটনা ঘটতে পারে।

সামাজিক প্রভাব

ঘটনাটি স্থানীয়ভাবে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে। দুর্গাপূজা চলাকালে ধর্মীয় উৎসবের পরিবেশ নষ্ট করার মতো এ ধরনের ঘটনা সামাজিকভাবে অশান্তি সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। অনেকেই বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে কাউকে গ্রেপ্তার করছে না।

সিরাজগঞ্জের স্থানীয় নাগরিক সমাজ মনে করছে, পূজা একটি ধর্মীয় উৎসব হলেও এটি এখন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উৎসবের রূপ নিয়েছে। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা হলে তা কেবল পুলিশ নয়, গোটা সমাজের নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করে।

রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

সিরাজগঞ্জ দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় জেলা। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাব রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত অনেকেই পূজা বা অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে থাকেন।

মামলার প্রধান আসামি সাইফুল ইসলামও স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং স্বেচ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতা। ফলে তার বিরুদ্ধে মামলার পরও পুলিশ তাৎক্ষণিক কোনো পদক্ষেপ নিতে দ্বিধায় রয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন।

অতীতের অনুরূপ ঘটনা

বাংলাদেশে এর আগেও পূজা মণ্ডপকে ঘিরে বেশ কিছু বিশৃঙ্খলার ঘটনা ঘটেছে।

  • ২০২১ সালে কুমিল্লায় পূজা মণ্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে।
  • ২০২২ সালে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে পূজা মণ্ডপে শব্দদূষণ এবং রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়।
  • প্রতিবার এসব ঘটনার পরই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর পদক্ষেপের আশ্বাস দিলেও অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেরি হয়।

নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতামত

আইনশৃঙ্খলা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পূজা বা এ ধরনের বৃহৎ উৎসবগুলোতে কেবল নিরাপত্তা বাহিনী মোতায়েন করাই যথেষ্ট নয়। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের একজন অধ্যাপক বলেন, “পুলিশের ওপর হামলা কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য হুমকিস্বরূপ। দ্রুত বিচার আইনে এ ধরনের অপরাধের বিচার হওয়া উচিত।”

পুলিশের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ

সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন জানিয়েছেন, “আমাদের কাছে আপডেট খুব বেশি নেই। তবে মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

পুলিশ প্রশাসনের দাবি, আসামিরা যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় পূজা মণ্ডপে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনাটি শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন। পূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও বটে। সেখানে পুলিশের ওপর হামলা মানে রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলার ওপর আঘাত।

এখন দেখার বিষয়, মামলা হলেও পুলিশ কত দ্রুত আসামিদের গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করতে পারে। কারণ দেরি হলে জনগণের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা ও হতাশা আরও বাড়বে।

MAH – 13098 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button