
নিউইয়র্কে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেনের ওপর হামলার ঘটনায় অবশেষে যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে আটক করেছে নিউইয়র্ক পুলিশ। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তির নাম মিজানুর রহমান, যিনি সিলেটের বাসিন্দা এবং দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে সক্রিয়ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
পুলিশ সূত্রে জানা যায়, স্থানীয় সময় সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) রাত ৯টা ২৮ মিনিটে জ্যাকসন হাইটস এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিজানুর রহমানকে আটক করা হয়। এ সময় তাকে হাতকড়া পরিয়ে থানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
এই ঘটনা প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। অনেকে মনে করছেন, প্রবাসে থেকেও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বন্দ্ব এবং ব্যক্তিগত শত্রুতা এখন সরাসরি সহিংসতায় রূপ নিচ্ছে।
কী ঘটেছিল হামলার দিন?
ঘটনাস্থল সূত্রে জানা যায়, এনসিপি নেতা আখতার হোসেন একটি সাংগঠনিক বৈঠক শেষে বাসায় ফেরার পথে তাকে লক্ষ্য করে মিজানুর রহমানসহ কয়েকজন যুবক আকস্মিকভাবে হামলা চালায়।
হামলায় আখতার হোসেন মাথা ও কাঁধে আঘাত পান। স্থানীয় প্রবাসী বাংলাদেশিরা দ্রুত তাকে কাছের একটি হাসপাতালে ভর্তি করেন। চিকিৎসকরা জানান, আঘাত গুরুতর হলেও তিনি এখন শঙ্কামুক্ত।
এ ঘটনার পর নিউইয়র্কের বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও প্রবাসী রাজনৈতিক নেতারা হামলার তীব্র নিন্দা জানান।
গ্রেপ্তার হওয়া যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমান কে?
মিজানুর রহমান সিলেটের সন্তান হলেও বহু বছর ধরে নিউইয়র্কে বসবাস করছেন। স্থানীয় প্রবাসী রাজনীতিতে তিনি যুবলীগের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময়ে তিনি নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
অভিযোগ রয়েছে, প্রবাসী রাজনীতির নামে তিনি চাঁদাবাজি, দলীয় বিরোধ ও ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার কাজে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছিলেন। যদিও এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো মামলা আগে হয়নি।
প্রবাসে রাজনীতির রেষারেষি
বাংলাদেশি প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় আবাসস্থলগুলোর মধ্যে নিউইয়র্ক অন্যতম। এখানে প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশি বসবাস করেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ দেশের রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত।
কেবল আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা জাতীয় পার্টি নয়—এনসিপি’র মতো অপেক্ষাকৃত ছোট দলগুলোও প্রবাসে শক্ত ঘাঁটি তৈরি করেছে। প্রায়ই দেখা যায়, দেশের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বিদেশের মাটিতেও তীব্র আকার ধারণ করে।
এই হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেকেই বলছেন,
- রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে প্রবাসীদের মধ্যে যে বিভাজন তৈরি হচ্ছে তা দিন দিন বাড়ছে।
- নিউইয়র্কে রাজনৈতিক সংঘর্ষের কারণে নতুন প্রজন্মের তরুণ প্রবাসীরা রাজনীতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
- বাংলাদেশি কমিউনিটির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
আখতার হোসেনের ভূমিকা ও রাজনৈতিক অবস্থান
এনসিপি নেতা আখতার হোসেন দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসে থেকে দল সংগঠিত করছেন। তিনি নিউইয়র্কে এনসিপির সাংগঠনিক কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছেন। দলীয় সূত্রে জানা যায়, সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশ সফরের পরিকল্পনা করছিলেন এবং দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যোগাযোগ রাখছিলেন।
অনেকে মনে করছেন, তার জনপ্রিয়তা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে বিরোধী পক্ষ ক্ষুব্ধ হয়েই এই হামলা চালিয়েছে।
পুলিশ ও আদালতের পদক্ষেপ
নিউইয়র্ক পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, হামলার ঘটনায় মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং বিস্তারিত তদন্ত চলছে। অভিযুক্ত মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে “অ্যাসল্ট চার্জ” আনা হয়েছে। প্রমাণ পেলে তাকে দীর্ঘ মেয়াদি কারাদণ্ডের মুখোমুখি হতে হতে পারে।
আগামী সপ্তাহে তাকে আদালতে হাজির করা হবে বলে জানা গেছে। পুলিশ আরও বলছে, ঘটনার সঙ্গে অন্য কেউ জড়িত থাকলে তারাও আইনের আওতায় আসবেন।
প্রবাসী সমাজের প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনার পর প্রবাসী বাংলাদেশি সমাজে ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেকেই লিখেছেন—
- “প্রবাসে এসে শান্তিতে বসবাস করার কথা, কিন্তু এখানে রাজনীতির নামে মারামারি-খুনাখুনি হচ্ছে।”
- “আমরা চাই প্রবাসী রাজনীতিতে শান্তি ও ভ্রাতৃত্ব। এই ধরণের সহিংসতা বাংলাদেশিদের সুনাম ক্ষুণ্ন করছে।”
- “যে দলেরই হোক, হামলাকারীদের শাস্তি হওয়া উচিত।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
প্রবাসে বাংলাদেশি রাজনীতি নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা করছেন সমাজবিজ্ঞানী ও লেখকরা। তাদের মতে—
- প্রবাসে রাজনৈতিক সহিংসতা হলে স্থানীয় পুলিশ ও আদালত সাধারণত কঠোর ব্যবস্থা নেয়।
- বাংলাদেশি কমিউনিটি যত বড় হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাবও তত বাড়ছে।
- তবে এ ধরণের সহিংসতা ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মকে রাজনীতি থেকে নিরুৎসাহিত করবে।
সমাধান কোথায়?
অনেকেই বলছেন,
- প্রবাসী সংগঠনগুলোর উচিত রাজনীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কার্যক্রমে জোর দেওয়া।
- রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকলেও সহিংসতার পরিবর্তে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন।
- বাংলাদেশ সরকারের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং দূতাবাসেরও এ বিষয়ে উদ্যোগী হওয়া দরকার।
নিউইয়র্কে এনসিপি নেতা আখতার হোসেনের ওপর হামলা এবং যুবলীগ নেতা মিজানুর রহমানের গ্রেপ্তার প্রমাণ করে যে, প্রবাসে থেকেও রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কতটা ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
এটি শুধু প্রবাসী বাংলাদেশিদের নয়, বরং গোটা জাতির জন্যই লজ্জাজনক একটি ঘটনা। সময় এসেছে সবাইকে মিলেমিশে প্রবাসে বাংলাদেশিদের মর্যাদা রক্ষায় কাজ করার।
MAH – 12962 I Signalbd.com