যশোরে সারসংকট, অনিয়ম-দুর্নীতি ও কৃষক বিরোধী নীতির প্রতিবাদে পাঁচ দফা দাবি জানিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতীয় কৃষক খেতমজুর সমিতি। সোমবার দুপুরে জেলা শহরের ভোলা ট্যাংক সড়কে সমিতির অস্থায়ী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নেতারা এই দাবি প্রকাশ করেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সমিতির কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক ও জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক জিল্লুর রহমান ভিটু। তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার আগের সরকারগুলোর মতোই কৃষকবিরোধী নীতি অব্যাহত রেখেছে। সার ও কৃষি পণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সারের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কৃষককে চরম সমস্যার মধ্যে ফেলছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ইরি-বোরো মৌসুমে দেশের কৃষি উৎপাদন বিপন্ন হবে।”
পাঁচ দফা দাবির সারসংক্ষেপ
জাতীয় কৃষক খেতমজুর সমিতির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা পাঁচ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে:
- সরাসরি কৃষকের হাতে সার সরবরাহ:
বোরো মৌসুমে কৃষি কার্যালয়ের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় সার সরাসরি কৃষকের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। - বরাদ্দ ও ডিলার তথ্য প্রকাশ:
সারের বরাদ্দ, ডিলারদের নাম ও বরাদ্দকৃত পরিমাণ জনসম্মুখে প্রকাশ করা। - ভুয়া ও বহিরাগত ডিলার বন্ধ:
অনিয়ম ও প্রতারণা রোধে অবৈধ ও ভুয়া ডিলারশিপ বাতিল করা। - ভেজাল সার, বীজ ও কীটনাশক প্রতিরোধ:
কৃষি পণ্যের উৎপাদন ও মান রক্ষায় ভেজাল সার, বীজ ও কীটনাশক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। - অবৈধ ঘের অপসারণ ও জমি সংরক্ষণ:
যত্রতত্র গড়ে ওঠা অবৈধ ঘের অপসারণ, ঘের নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং কৃষিজমিকে আবাসনের নামে হ্রাস না করা।
সারসংকটের প্রভাব: কৃষক দিশেহারা
জিল্লুর রহমান ভিটু আরও বলেন, “সারের মূল্যবৃদ্ধি ও কৃত্রিম সংকটের কারণে সাধারণ কৃষক দিশেহারা। বাজারে সারের অস্বাভাবিক দাম কৃষককে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করেছে। এ পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে ধান, গম ও অন্যান্য ফসলের উৎপাদন বিপন্ন হবে।”
তিনি জানান, কৃষকদের হাতে সারের যথাযথ ও সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত না হলে ৩১ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাওয়ের কর্মসূচি নেওয়া হবে।
ভেজাল সার ও কৃষি উপকরণ: বিপন্ন হচ্ছে কৃষি উৎপাদন
সংবাদ সম্মেলনে সমিতির নেতারা বলেন, “ভেজাল সার ও কীটনাশকের কারণে কৃষিপণ্য উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কৃষক প্রতারিত হচ্ছেন। যদিও সংবাদপত্রে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে, তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না।”
তারা আরও অভিযোগ করেন, “বিএডিসিতে বীজ আসার সঙ্গে সঙ্গে কর্মকর্তারা তা পছন্দমতো নির্দিষ্ট লোকের হাতে দিয়ে দিচ্ছেন। যত্রতত্র ঘের গড়ে ওঠায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে এবং ফসলি জমি চাষের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। আবাসনের নামে কৃষিজমি হ্রাস করা হচ্ছে, যা অতি জরুরি ভিত্তিতে রোধ করতে হবে।”
সমিতির নেতাদের বক্তব্য
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন:
- জাতীয় কৃষক খেতমজুর সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মিজানুর রহমান
- কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক তসলিম-উর-রহমান
- জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল বিশ্বাস
তারা সবাই একমত হয়েছেন যে, কৃষকদের অধিকার রক্ষায় সরকারকে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া, সারের বাজার নিয়ন্ত্রণ, কৃষি উপকরণের মান নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ জমি দখল রোধে নীতি প্রণয়ন জরুরি।
সারসংকট ও কৃষি খাতের বর্তমান পরিস্থিতি
বাংলাদেশের কৃষি খাত অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। বিশেষ করে ধান, গম, আলু ও অন্যান্য ফসলের জন্য সার অপরিহার্য। তবে সম্প্রতি সার সরবরাহে অনিয়ম, ভুয়া ডিলার ও মূল্যস্ফীতি কৃষককে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।
সরকারি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৫ সালের বোরো মৌসুমে সার সরবরাহের পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন না হলে দেশের কৃষি উৎপাদন লক্ষ্য পূরণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এছাড়া, ভেজাল সার ও কীটনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধির কারণে ফসলের মান ও উৎপাদন দুটোই কমছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “কৃষকবিরোধী নীতি ও সারের কৃত্রিম সংকট রোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হলে কৃষি খাতের সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে। কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং দেশের অর্থনীতিই প্রভাবিত হবে।”
কৃষক সমিতির হুঁশিয়ারি: ডিসি অফিস ঘেরাও
জাতীয় কৃষক খেতমজুর সমিতি হুঁশিয়ারি দিয়েছে, দাবিগুলো মানা না হলে তারা ৩১ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করবে। এটি দেশের কৃষক আন্দোলনের অংশ হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে।
জিল্লুর রহমান ভিটু বলেন, “আমরা কোনো অশান্তি চাই না। তবে কৃষক আন্দোলন ছাড়া আমাদের দাবি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। দেশের কৃষকরা স্বাভাবিক উৎপাদনের অধিকার পেতে হবে। আমরা সরকারের কাছে দাবী জানাই, অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।”
সরকারের প্রতিক্রিয়া ও পরবর্তী পদক্ষেপ
এখন পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসন ও জেলা কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে সমিতির নেতারা জানিয়েছেন, যদি সরকার সময়মতো পদক্ষেপ না নেয়, তবে তারা বৃহত্তর কর্মসূচি নেওয়ার পরিকল্পনা করছে।
যশোরে জাতীয় কৃষক খেতমজুর সমিতির এই পাঁচ দফা দাবি দেশের কৃষি খাতের বর্তমান সংকট এবং কৃষকের অবস্থা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করছে। সারসংকট, ভেজাল সার, অবৈধ জমি দখল ও কৃষকবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে কৃষকের স্বর তুলে দেওয়া এই আন্দোলন কৃষি খাতের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তনের পথ সুগম করতে পারে।
MAH – 14192 I Signalbd.com



