কৃষি

আফগান কৃষকদের সহায়তায় সৌদি আরবের নতুন কৃষি প্রকল্প

Advertisement

আফগানিস্তানের দীর্ঘদিনের খাদ্য সংকট, গ্রামীণ দারিদ্র্য ও কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার বাস্তবতায় দেশটির কৃষকদের জন্য নতুন আশার আলো নিয়ে এসেছে সৌদি আরব। দেশটির অর্থায়নে ১০ লাখ মার্কিন ডলারের একটি নতুন কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা প্রকল্প চালু হয়েছে, যা আফগানিস্তানের ক্ষুদ্র কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং কৃষি উৎপাদনকে টেকসই করার লক্ষ্যে বড় ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট (এসএফডি)–এর অর্থায়নে, এবং তা পরিচালনা করবে আফগানিস্তান হিউম্যানিটারিয়ান ট্রাস্ট ফান্ড (এএইচটিএফ)আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটি (আইসিআরসি)

এটি শুধু একটি কৃষি প্রকল্প নয়—এটি যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের গ্রামীণ অর্থনীতিকে প্রাণবন্ত করার, কৃষকদের আধুনিক কৃষিদক্ষতায় সক্ষম করে তোলার এবং খাদ্য সংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো তৈরির একটি বড় উদ্যোগ।

আফগানিস্তানের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিনির্ভর, তবুও সংকট গভীর

আফগানিস্তান মানবিক ট্রাস্ট ফান্ডের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষি ও কৃষি–নির্ভর জীবিকায় যুক্ত। কিন্তু দশকব্যাপী সংঘাত, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, জলবায়ু পরিবর্তন ও অবকাঠামো ধ্বংসের ফলে কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে।

কৃষকদের বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে—

  • পর্যাপ্ত সেচব্যবস্থার অভাব
  • পানির সংকট
  • আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে অজ্ঞতা
  • বৃষ্টিনির্ভর কৃষি
  • জমির ক্ষয় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ
  • বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতা
  • পোকামাকড় ও রোগবালাইয়ের অনিয়ন্ত্রিত প্রভাব

এসব চ্যালেঞ্জের কারণে আফগান জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রতিনিয়ত খাদ্য অনিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকে। অনেক অঞ্চলে পরিবারগুলো মৌসুমি খাদ্য সংকটের মুখোমুখি হয়, যা মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায়।

১০ লাখ ডলারের কৃষি প্রকল্প: কী থাকছে এই উদ্যোগে?

নতুন এই প্রকল্পটির লক্ষ্য কৃষকদের শুধু তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া নয়; বরং তাদের দীর্ঘমেয়াদে স্বনির্ভর করে তোলা। প্রকল্পের মূল উপাদানগুলো হলো—

১. ক্ষুদ্র কৃষকদের সহায়তা ও অনুদান প্রদান

৭৬১টি কৃষক পরিবারকে প্রদান করা হবে সরাসরি আর্থিক সহায়তা। এই তহবিল দিয়ে তারা—

  • বীজ
  • সার
  • কৃষি যন্ত্রপাতি
  • পোকামাকড় প্রতিরোধী উপকরণ
  • ছোট সেচ সরঞ্জাম

ক্রয় করতে পারবেন, যা তাদের মাঠে উৎপাদন বাড়াতে সরাসরি সহায়তা করবে।

২. আধুনিক ও জলবায়ু–সহনশীল কৃষি প্রশিক্ষণ

আফগানিস্তানের পূর্ব, উত্তর ও উত্তর–পূর্বাঞ্চল জুড়ে শতাধিক কৃষককে দেওয়া হবে—

  • টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রশিক্ষণ
  • ফসল উৎপাদনের উন্নত কৌশল
  • পানি ব্যবস্থাপনার আধুনিক পদ্ধতি
  • পোকামাকড় দমন ও নিয়ন্ত্রণ
  • মাটি সংরক্ষণ ও জমি উন্নয়ন
  • সেচ পরিকল্পনা
  • সবজি ও শস্য উৎপাদন বৃদ্ধির কৌশল

এগুলো কৃষকদের দক্ষতা বাড়িয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সহায়তা করবে।

৩. সেচব্যবস্থা পুনর্বাসন ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন

সেচ ব্যবস্থার দুর্বলতা আফগানিস্তানের কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার অন্যতম বড় কারণ। এই প্রকল্পে—

  • খাল পুনর্নির্মাণ
  • ভূগর্ভস্থ পানি সংরক্ষণ
  • ক্ষতিগ্রস্ত সেচলাইন মেরামত
  • ছোট বাঁধ ও পানি ধারণ ব্যবস্থার উন্নয়ন

এর ওপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।

৪. ক্যাশ ফর ওয়ার্ক কর্মসূচি: ৫০০ জনের অস্থায়ী কর্মসংস্থান

ক্যাশ ফর ওয়ার্ক কর্মসূচিতে স্থানীয় মানুষদের নিয়োগ দেওয়া হবে—

  • সেচ খাল পরিষ্কার
  • মাটি সুরক্ষা
  • রাস্তা মেরামত
  • পানি সংরক্ষণমূলক কাঠামো উন্নয়ন

এতে একদিকে স্থানীয় অবকাঠামো উন্নত হবে, অন্যদিকে ৫০০ জন শ্রমিক অস্থায়ী আয়ের সুযোগ পাবেন।

৫. কৃষক পরিবারগুলোর সক্ষমতা উন্নয়ন

কৃষকদের জন্য আয়োজন করা হবে বিশেষ ক্যাপাসিটি বিল্ডিং সেশন

  • ব্যবসায়িক দক্ষতা
  • ফসল বাজারজাতকরণ
  • উৎপাদন ব্যয়ের হিসাব
  • টেকসই কৃষি ব্যবস্থাপনা
  • চাষের পরিকল্পনা
  • কৃষিভিত্তিক ক্ষুদ্র উদ্যোগ

এগুলো কৃষকদের পরিবারভিত্তিক আয়ে বৈচিত্র্য এনে স্থিতিশীলতা বাড়াবে।

মানবিক ও টেকসই উন্নয়নে বড় অবদান: আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রশংসা

আইসিআরসি–র প্রতিনিধি ক্যাথারিনা রিটজ বলেন—

“এই প্রকল্প শুধু আজকের খাদ্য সংকট মোকাবিলা করবে না। এটি আফগান কৃষকদের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা ও সহনশীলতা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। আমরা বিশ্বাস করি, স্থানীয় কৃষকদের ক্ষমতায়নের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী গ্রামীণ অর্থনীতি গড়ে উঠবে।”

ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের আঞ্চলিক পরিচালক ড. ওয়ালিদ আবদুলওয়াহাব বলেন—

“সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের এ ধরনের সহায়তা হাজার হাজার পরিবারের জীবনে আলো ছড়াবে। এটি মানবিক সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক পারস্পরিক সহযোগিতার সেরা উদাহরণ।”

আফগানিস্তান মানবিক ট্রাস্ট ফান্ড: সংকটময় সময়ে বড় ভূমিকা

২০২১ সালে ওআইসি–র পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সিদ্ধান্তে গঠিত এই তহবিলটি আফগানিস্তানের মানবিক সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এর মাধ্যমে—

  • খাদ্য
  • চিকিৎসা
  • আশ্রয়
  • কৃষি উন্নয়ন
  • গ্রামীণ অবকাঠামো
  • জরুরি ত্রাণসামগ্রী

বিভিন্ন খাতেই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।

সংস্থাটি জানায়, আফগানিস্তানের মানুষের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এখন প্রয়োজনের চেয়েও বেশি।

আগের মানবিক উদ্যোগ: আইএসডিবি ও আইসিআরসি–র সফল উদাহরণ

২০২২ সালে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির একটি স্বাস্থ্য প্রকল্পে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছিল।

সেই উদ্যোগে—

  • ৪০টিরও বেশি হাসপাতাল
  • শতাধিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র
  • চিকিৎসাকর্মী
  • রোগীদের জন্য ওষুধ ও মেডিকেল সরঞ্জাম

পৌঁছে দেওয়া হয়। এতে ১৭ লাখেরও বেশি মানুষ উপকৃত হয়।

এই সফলতার ওপর ভিত্তি করেই এবার কৃষিখাতে বড় ধরনের সহযোগিতায় এগিয়ে এসেছে সৌদি আরব।

কেন আফগানিস্তানে কৃষি উন্নয়ন এখন সবচেয়ে জরুরি?

আফগানিস্তানের জলবায়ু দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। খরার পরিমাণ বেড়েছে, নদীর পানি কমেছে, বরফ গলার হার বদলে গেছে। পাশাপাশি অবকাঠামো ধ্বংস, নিরাপত্তাহীনতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে কৃষকরা বিনিয়োগ করতে ভয় পান।

ফলে—

  • কৃষি জমি অনাবাদী
  • উৎপাদন কম
  • বাজারে চাল–গমের ঘাটতি
  • পশুপালনে রোগ
  • খাদ্য মূল্যবৃদ্ধি
  • দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি

সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

এই প্রেক্ষাপটে সৌদি আরবের এই million-dollar প্রকল্প আফগান কৃষিতে নতুন প্রাণ এনে দিতে পারে।

প্রকল্পটি কীভাবে মানুষের জীবন বদলাবে?

⦿ ১০ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবিকা সরাসরি প্রভাবিত হবে।
⦿ ৭৬১টি কৃষক পরিবার আর্থিক সহায়তা পাবে, যা তাদের উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করবে।
⦿ ৫০০ জন শ্রমিক সাময়িক কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবে, যা কঠিন সময়ে তাদের পরিবারকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করবে।
⦿ কৃষকরা আধুনিক কৃষি দক্ষতা অর্জন করে দীর্ঘমেয়াদে স্বনির্ভর হয়ে উঠবে।
⦿ পানি ব্যবস্থাপনার উন্নতি হলে ফসল উৎপাদন বাড়বে, খরার ক্ষতি কমবে।
⦿ গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হবে, স্থানীয় বাজার সচল হবে।

সব মিলিয়ে এটি আফগানিস্তানের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য একটি পুনর্জাগরণের পথ তৈরি করবে।

বিশ্লেষণ: আফগানিস্তানের কৃষিতে সৌদি বিনিয়োগের কৌশলগত গুরুত্ব

সৌদি আরব গত কয়েক বছর ধরে আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তা খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থায়ন করছে। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের সংকটপূর্ণ অঞ্চলগুলোতে বৃহৎ প্রকল্পে অংশ নিচ্ছে দেশটি। আফগানিস্তান তার একটি বড় উদাহরণ।

১. আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা

অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল আফগানিস্তান দক্ষিণ–মধ্য এশিয়ার শান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

২. ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার প্রতি দায়বদ্ধতা

ওআইসি সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি আরবের নেতৃত্ব দীর্ঘদিনের।

৩. মানবিক সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক অবস্থান শক্তিশালী করা

এসএফডি বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য প্রকল্প পরিচালনা করছে।

আফগান কৃষকদের চোখে নতুন আশার আলো

সাম্প্রতিক মাঠ জরিপে জানা গেছে, আফগান কৃষকরা বীজ, সার ও সেচব্যবস্থার সংকটে দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। অনেক পরিবার বাধ্য হয়ে চাষাবাদ ছেড়ে অন্য অস্থায়ী কাজ খুঁজে নেয়।

কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থার এই প্রকল্প তাদের মধ্যে নতুন আশার জন্ম দিচ্ছে। বিশেষ করে—

  • নারীদের কৃষিকাজে অংশগ্রহণ
  • শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তি
  • স্থানীয় বাজারে শাকসবজি ও শস্যের যোগান বৃদ্ধি

এসব পরিবর্তন ইতিমধ্যেই কয়েকটি এলাকায় দেখা যাচ্ছে।

আফগানিস্তানের কৃষি পুনরুদ্ধারে বড় ভূমিকা রাখবে এই প্রকল্প

সৌদি আরবের সহায়তায় চালু হওয়া ১০ লাখ ডলারের কৃষি প্রকল্প আফগানিস্তানের খাদ্য নিরাপত্তায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন।
যুদ্ধ–সংকটে জর্জরিত এই দেশে কৃষি সংস্কার যত জরুরি, ততটাই প্রয়োজন আন্তর্জাতিক সহযোগিতা।

ক্ষুদ্র কৃষকের সহায়তা, আধুনিক প্রশিক্ষণ, সেচব্যবস্থা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি—সব মিলিয়ে এই উদ্যোগ আফগানিস্তানের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।

MAH – 14092 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button