রাজশাহীর পবা উপজেলার অন্তর্গত নওহাটা এলাকা বরাবরই কৃষি উৎপাদনের জন্য পরিচিত। বিশেষ করে শীতকালীন সবজির মৌসুম শুরু হলেই এ অঞ্চলের মাঠে মাঠে সবুজের সমারোহ দেখা যায়। কৃষকেরা ভোরের আলো ফোটার আগেই নিজেদের যত্নে ফলানো তাজা সবজি নিয়ে ছুটে আসেন নওহাটা হাটে। আর এই হাটকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এক প্রাণচঞ্চল কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি।
সপ্তাহে দু’দিন—সোমবার ও বৃহস্পতিবার—এখানে বসে দেশের অন্যতম বড় পাইকারি সবজি হাট। শুধু রাজশাহী বা আশেপাশের জেলা নয়, চট্টগ্রাম, সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, নোয়াখালী, ময়মনসিংহ, নারায়ণগঞ্জ, টাঙ্গাইল এবং রাজধানী ঢাকার বড় বড় বাজারের পাইকাররা ভোর হতেই এখানে এসে ভিড় করেন। তাঁদের লক্ষ্য—তাজা সবজি কিনে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরবরাহ করা।
এই পুরো জমজমাট পরিবেশটিই নওহাটা হাটকে আলাদা পরিচিতি এনে দিয়েছে। কৃষকেরা এখানে যেমন ন্যায্য দাম পান, তেমনি পাইকাররাও দেশজুড়ে সরবরাহের জন্য মানসম্মত পণ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
পবা–মোহনপুর এলাকার কৃষির শক্তি: উৎপাদন বেড়েছে, আয়ের সুযোগও বাড়ছে
নওহাটা হাটের সবথেকে বড় ভিত্তি হলো রাজশাহীর পবা ও মোহনপুর উপজেলার বিস্তীর্ণ সবজি চাষের জমি। এখানকার মাটি উর্বর, সেচব্যবস্থা উন্নত, আর কৃষকেরা আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদেও এখন বেশ অভ্যস্ত। এ অঞ্চলের কৃষকেরা প্রধানত যেসব সবজি বাজারে আনেন—
- ফুলকপি
- বাঁধাকপি
- মুলো
- টমেটো
- বেগুন
- লাউ
- কুমড়া
- শিম
- লালশাক, পুঁইশাক
- শসা, করলা
- পেঁপে
- কচু, পটল
- লেটুস, ধনেপাতা, মোটরশুটি
শীত মৌসুমে এসব সবজির উৎপাদন বেড়ে যায়। কৃষকেরা জানান, সারা বছর বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপাদন হলেও শীতকালের সবজি চাহিদা সবচেয়ে বেশি থাকে।
ভোররাতের দৃশ্য: লরি, ভ্যান আর কৃষকের ভিড়ে গমগমে হাট
নওহাটা হাটের দিন ভোর হতে না হতেই চারদিকে দেখা যায় অন্য রকম ব্যস্ততা। অন্ধকার ভেদ করে বড় ট্রাক, পিকআপ ও ভ্যানগাড়ির সারি হাটের দিকে আসতে থাকে। কৃষকেরা মাথাভর্তি সবজির ঝুড়ি, বস্তা, বাঁশের খাঁচা কিংবা ছোট গাড়িতে বোঝাই করে হাটে উপস্থিত হন।
হাটের ভেতরে শুরু হয় দামে দরদাম। পাইকাররা দল বেঁধে ঘুরে ঘুরে সবজি বাছাই করেন। কেউ ফুলকপি পরীক্ষা করেন, কেউ টমেটোর লালচে রঙ আর গুণমান যাচাই করেন, কেউ আবার বস্তার ভেতর থাকা বেগুন হাত দিয়ে ওজন আন্দাজ করেন।
ভোর থেকে সকাল পর্যন্ত সবচেয়ে জমজমাট থাকে এই লেনদেন। কারণ পাইকাররা সকালে সবজিগুলো সংগ্রহ করে দ্রুত জেলা ও শহরগুলোর উদ্দেশে রওনা দেন, যাতে দিনের বাজারের আগেই সবজি পৌঁছাতে পারে।
কৃষকের মুখে হাসি: বাড়ছে ন্যায্য মূল্যের সুযোগ
আগের তুলনায় এখন কৃষকেরা নওহাটা হাটে ভালো দাম পান। কারণ—
১. অনেক পাইকার একসঙ্গে কেনাকাটা করতে আসায় প্রতিযোগিতা তৈরি হয়।
২. কৃষকেরা সরাসরি পাইকারদের কাছে বিক্রি করায় মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য কমেছে।
৩. উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় পরিবহন খরচও কম হচ্ছে।
একজন কৃষক বলেন,
“আগে লোকজন বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবজি কিনত, তখন দাম কম মিলত। এখন হাটে এনে বিক্রি করলে ভালো দাম পাওয়া যায়।”
দেশব্যাপী সরবরাহ: নওহাটা এখন উত্তরাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ হাব
কেন নওহাটা সবজি হাট দেশের নানা অঞ্চলের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ?
কারণ এই অঞ্চলে বছরের প্রায় পুরো সময়ই প্রচুর সবজি উৎপাদন হয়।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা নওহাটা থেকে সরাসরি সবজি সংগ্রহ করে পরিবহন করেন—
- ঢাকায় কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার, জুরাইন
- চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ
- সিলেটের আম্বরখানা বাজার
- খুলনার বড় বাজার
- ময়মনসিংহ শহরের পাইকারি বাজার
- রংপুর, বগুড়া, জয়পুরহাটের বাজার
বাংলাদেশে নগরাঞ্চলে প্রতিদিন যত সবজি পৌঁছে, তার একটি বড় অংশই আসে উত্তরাঞ্চলের খ্যাতনামা এই নওহাটা বাজার থেকে।
হাট পরিচালনা, নিরাপত্তা ও পরিবেশ: সবকিছুতেই উন্নতি
বর্তমানে নওহাটা হাট পরিচালনায় স্থানীয় প্রশাসন, পৌরসভা এবং বাজার কমিটি সমন্বিতভাবে কাজ করছে।
- হাটে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
- বাড়ানো হয়েছে পরিচ্ছন্নতা–সেবা।
- আবর্জনা অপসারণ, পানি নিষ্কাশন এবং রাস্তা মেরামতের কাজ নিয়মিত হচ্ছে।
- ট্রাফিক policরা রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করছেন, যাতে ভোররাতে যানজট না তৈরি হয়।
এতে কৃষক ও ব্যবসায়ী উভয়ের জন্য বাজারটি আরও সহনীয় ও নিরাপদ হয়ে উঠেছে।
মৌসুমি চ্যালেঞ্জ: দামে ওঠানামা, সংরক্ষণ সুবিধার অভাব
যদিও হাটটি ব্যস্ততার চূড়ায় থাকে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে—
১. অতিরিক্ত উৎপাদনের সময় দাম পড়ে যায়।
২. সবজি দীর্ঘক্ষণ রাখার মতো পর্যাপ্ত কোল্ড স্টোরেজ নেই।
৩. বর্ষাকালে রাস্তা কাদা হয়ে যায়, লেনদেনে সমস্যা হয়।
৪. বাজারে কখনো কখনো দালালদের দৌরাত্ম্য দেখা যায়।
তবে স্থানীয় প্রশাসন জানায়, এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই ধাপে ধাপে আধুনিকায়ন চলছে।
অর্থনীতিতে অবদান: হাজারো মানুষের জীবিকা গড়ে উঠেছে এই হাটকে ঘিরে
নওহাটা হাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিশাল অর্থনৈতিক কাঠামো। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যাঁরা যুক্ত—
- কৃষক
- পাইকার
- শ্রমিক
- বহনকারী
- ট্রাকচালক
- ছোট ব্যবসায়ী
- পরিবহন–মালিক
- দোকানদার
হাটের দিনে প্রায় হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ পান বলে জানা যায়। দেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে নওহাটা হাট তাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
ছবি–গল্পের আকর্ষণ: সবজির রং, কৃষকের হাসি আর বাজারের প্রাণচাঞ্চল্য
নওহাটা হাটের একটি বড় আকর্ষণ হলো এর দৃশ্যশোভা।
একদিকে সবুজ ফুলকপি, সাদা শালগম, বেগুনি বেগুন—
অন্যদিকে লাল টমেটো, গাঢ় সবুজ শসা, ঝকঝকে লাউ।
সেই সঙ্গে কৃষকের শ্রম, ঘাম, অর্জনের হাসি—সব মিলিয়ে এটি যেন এক জীবন্ত ছবি।
অনেক আলোকচিত্রী ও সংবাদমাধ্যম নিয়মিত এই হাটের ছবি করেন।
সবজির বৈচিত্র্য, মানুষের চলাচল, দরদাম, আলো–আঁধারির খেলা—সব মিলিয়ে নওহাটা হাট সত্যিকার অর্থেই একটি ছবির গল্প হয়ে ওঠে।
নওহাটা সবজি হাট—কৃষকের আশীর্বাদ, দেশের খাদ্য নিরাপত্তার ভরসা
বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষিখাতের উন্নয়নে নওহাটা সবজি হাটের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এখানে প্রতিদিন যে অগণিত সবজি কেনাবেচা হয়, তা শুধু স্থানীয় কৃষকের জীবনই বদলে দেয় না; দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের খাদ্যচাহিদাও পূরণ করে।
পবা ও মোহনপুর উপজেলার কৃষকেরা বলেন,
“নওহাটা হাট না থাকলে আমরা এই পরিমাণ সবজি এত ভালো দামে বিক্রি করতে পারতাম না।”
এ হাট শুধু একটি বাজার নয়—এটি উত্তরাঞ্চলের কৃষির প্রাণকেন্দ্র, মানুষের জীবিকার উৎস এবং বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
MAH – 13927 I Signalbd.com



