৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা: জনগণের জীবনমান উন্নয়নে জোর দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা

২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য দেশের সর্ববৃহৎ বাজেট উপস্থাপন করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। সোমবার জাতীয় সংসদে উত্থাপিত এই বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১১ শতাংশ বেশি। এবারের বাজেটকে তিনি অভিহিত করেছেন “বাস্তবসম্মত, কল্যাণমুখী ও সমতাভিত্তিক বাজেট” হিসেবে।
বাজেট বক্তৃতা সরাসরি সম্প্রচার করেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি)। বক্তৃতার শুরুতেই অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “এই বাজেট এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে দেশের প্রবৃদ্ধির সুফল সাধারণ মানুষ পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আমাদের লক্ষ্য হলো – জীবন-জীবিকার মানোন্নয়ন।”
বাজেটের মোট কাঠামো: ব্যয় বনাম আয়
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের মোট ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে:
- পরিচালন ও অন্যান্য খাতে ব্যয়: ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা
- বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি): ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা
অন্যদিকে মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ। এই আয়ের মধ্যে:
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর): ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা
- অন্য উৎস: ৬৫ হাজার কোটি টাকা
ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
ঘাটতি মোকাবেলায় অর্থের উৎস
এই বিশাল বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার দুটি উৎসের ওপর নির্ভর করবে:
- অভ্যন্তরীণ উৎস: ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা
- বৈদেশিক উৎস: ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা
অর্থ উপদেষ্টা জানান, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণ নির্ভরতা কিছুটা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বাড়ানো।
খাতভিত্তিক ব্যয় বরাদ্দ: কোন খাতে কত টাকা
বাজেটে কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে উল্লেখযোগ্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে:
- বেতন-ভাতা: ৯৭ হাজার কোটি টাকা
- সুদ পরিশোধ: ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা
- বিদ্যুৎ ও সার ভর্তুকি: ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা
- সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি: ১ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা
- শিক্ষা খাতে সম্ভাব্য বরাদ্দ: প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি
- স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ: প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা (প্রত্যাশিত)
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে বরাদ্দ বাড়ানো সরকারের একটি বড় নীতিগত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
রাজস্ব আহরণ পরিকল্পনা: এনবিআর-এর কাঁধে ভারী দায়িত্ব
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বেশি। করজাল সম্প্রসারণ, প্রযুক্তি নির্ভর কর সংগ্রহ এবং কর ফাঁকি রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এবারের বাজেটে আয়কর ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ডিজিটাল ই-রিসিট চালু, অটোমেশন বৃদ্ধির পরিকল্পনা, এবং করপ্রদানে স্বচ্ছতা আনতেই এ উদ্যোগ।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ শতাংশের মধ্যে। তবে চলমান বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে বাজেটে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়ে গেছে।
অর্থ উপদেষ্টা এ বিষয়ে বলেন, “আমরা মনিটারি পলিসির সাথে সমন্বয় রেখে বাজেট বাস্তবায়ন করবো, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায়।”
জনগণের প্রত্যাশা: কর্মসংস্থান, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও দুর্নীতি দমন
বাজেট ঘোষণার পর সাধারণ জনগণ, ব্যবসায়ী মহল ও অর্থনীতিবিদরা বাজেট বিশ্লেষণে নানা প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন। অধিকাংশ অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, বাজেটের আকার ইতিবাচক হলেও বাস্তবায়নই হচ্ছে মূল চ্যালেঞ্জ।
অন্যদিকে নাগরিক সমাজ বলছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় বাজেট বাস্তবায়নের দিকেই সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি বলেছে, “যথাযথ তদারকি ও দুর্নীতি রোধ ছাড়া এডিপির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ কঠিন হবে।”
সালেহউদ্দিনের দৃষ্টিভঙ্গি: “সমতা ও কল্যাণই মূল লক্ষ্য”
প্রথম আলোকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “আমরা এমন একটি বাজেট দিচ্ছি যাতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারেন। প্রবৃদ্ধি যেন কেবল কিছু শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, সে বিষয়টি মাথায় রেখেই বাজেট প্রণয়ন করা হয়েছে।”
বাজেট বাস্তবায়নই মূল চ্যালেঞ্জ
২০২৫-২৬ অর্থবছরের এই বাজেট নিঃসন্দেহে দেশের ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ বাজেট। বিশাল আকারের বাজেট প্রস্তাবিত হলেও জনগণের জীবনে তার প্রভাব নির্ভর করবে বাজেট বাস্তবায়নের দক্ষতা, সুশাসন এবং স্বচ্ছতার ওপর।
বাজেট প্রণয়ন শুধু একটি কৌশলগত ঘোষণা নয়, এটি বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন যথাযথ পরিকল্পনা, দক্ষ প্রশাসন এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেই দিক থেকেই এই বাজেট কতটা কার্যকর হয়, তা সময়ই বলে দেবে।