ড. ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট দিল জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ও সামাজিক ব্যবসা ধারণার প্রবর্তক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে জাপানের প্রখ্যাত সোকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তাঁর সামাজিক উদ্ভাবন, দারিদ্র্য দূরীকরণে অবদান এবং বিশ্বব্যাপী মানবকল্যাণে অব্যাহত প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
সম্মাননা গ্রহণ ও বক্তব্য
শুক্রবার (৩০ মে) টোকিওতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়োজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট তোমোহিরো সুজুকি ড. ইউনূসের হাতে এই সম্মানসূচক ডক্টরেট তুলে দেন।
অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য দূরীকরণে সামাজিক ব্যবসার ভূমিকা, টেকসই উন্নয়ন ও তরুণ প্রজন্মের দায়িত্ব নিয়ে এক অনুপ্রেরণামূলক বক্তব্য রাখেন।
তিনি বলেন,
“আমরা যদি তরুণদের উদ্ভাবন ও সহমর্মিতার দিকে পরিচালিত করতে পারি, তাহলে বিশ্বে কোনো সমস্যাই স্থায়ী থাকবে না। দারিদ্র্য মানুষের তৈরি, সুতরাং মানুষই তা দূর করতে পারবে।”
সোকা বিশ্ববিদ্যালয়: শান্তি ও মানবতার অনুশীলনভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
সোকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এটি জাপানের অন্যতম শান্তিবাদী ও মানবিক মূল্যবোধ-ভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বশান্তি, সংহতি, সামাজিক ন্যায্যতা ও আন্তঃসাংস্কৃতিক বোঝাপড়াকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট সুজুকি বলেন,
“ড. ইউনূস শুধু অর্থনীতিবিদ নন, তিনি একজন মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন বিশ্বনেতা। তাঁর ‘গ্রামীণ ব্যাংক’ মডেল ও সামাজিক ব্যবসা ধারণা দুনিয়া জুড়ে কোটি মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলেছে।”
চার দিনের সরকারি সফরে জাপানে ইউনূস
অধ্যাপক ইউনূস গত ২৭ মে জাপানে চার দিনের সরকারি সফরে পৌঁছান। এই সফরের অংশ হিসেবে তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা এবং বিভিন্ন সামাজিক সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন।
তিনি আগামীকাল ৩১ মে সকালে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে টোকিও ত্যাগ করবেন এবং সিঙ্গাপুর হয়ে রাতেই ঢাকায় পৌঁছানোর কথা রয়েছে।
ইউনূসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি: এটি ৬৪তম সম্মানসূচক ডিগ্রি
ড. ইউনূসের আন্তর্জাতিক খ্যাতি কোনো নতুন বিষয় নয়। তিনি বিশ্বের ৩০টির বেশি দেশের ৬০টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ স্বীকৃতি তাঁর জন্য ৬৪তম সম্মানসূচক ডিগ্রি।
নোবেল শান্তি পুরস্কার (২০০৬) ছাড়াও তিনি ফ্রান্সের ‘লেজিয়ন দ’অনার’, যুক্তরাষ্ট্রের ‘প্রেসিডেনশিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ এবং ‘কংগ্রেশনাল গোল্ড মেডেল’-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করেছেন।
ড. ইউনূস ও সামাজিক ব্যবসা: একটি বৈপ্লবিক ধারণা
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বব্যাপী ‘সোশ্যাল বিজনেস’ বা সামাজিক ব্যবসা ধারণার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মতে,
“একটি ব্যবসা শুধুই মুনাফার জন্য নয়, বরং এটি হতে পারে দারিদ্র্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সংকট মোকাবেলার একটি কার্যকর হাতিয়ার।”
এই ধারণা বিশ্বব্যাপী সামাজিক উদ্যোক্তাদের অনুপ্রাণিত করেছে। ইউনূস সেন্টারসহ তার পরিচালিত প্রকল্পগুলো বিশ্বের শতাধিক দেশে কাজ করছে। সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডিগ্রিটি এ উদ্যোগের বৈশ্বিক স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
সমসাময়িক প্রসঙ্গ: বাংলাদেশে ইউনূস বিতর্কের মধ্যেও আন্তর্জাতিক সম্মান
বর্তমানে বাংলাদেশে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলাসহ বিতর্ক চলছে। তবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, অবদান ও ভাবমূর্তি এখনও অক্ষুন্ন রয়েছে। সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা এ কথাই প্রমাণ করে যে বিশ্ব সম্প্রদায় এখনো তাঁকে ‘দারিদ্র্যবিরোধী লড়াইয়ের প্রতীক’ হিসেবেই দেখছে।
বিশ্লেষকদের মতে,
“দেশে বিতর্ক থাকলেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইউনূস এখনও সম্মান পাচ্ছেন। এটি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এমন একজন নাগরিক যিনি বৈশ্বিক সম্মান পান, তিনি দেশের মুখ উজ্জ্বল করছেন।”
ছাত্র-তরুণদের উদ্দেশ্যে অনুপ্রেরণা
সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বক্তব্যে ড. ইউনূস নতুন প্রজন্মকে উদ্দেশ করে বলেন,
“আপনাদের হাতেই ভবিষ্যৎ। আপনি চাইলেই বিশ্ব বদলে দিতে পারেন—তবে সেটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন আপনি সমস্যাকে দেখবেন ব্যবসার দৃষ্টিভঙ্গিতে, সামাজিক কল্যাণের জন্য।”
ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা
টোকিও সফর শেষে ঢাকায় ফিরে তিনি ইউনূস সেন্টারের বিভিন্ন সামাজিক ব্যবসা প্রকল্প এবং শিক্ষাবিষয়ক কার্যক্রমে মনোনিবেশ করবেন বলে তাঁর ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু সংকট, তরুণ উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বিকাশ এবং নারীর ক্ষমতায়ন তাঁর কর্মসূচির মূল অগ্রাধিকার।
জাপানের সোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মাননা শুধু ড. ইউনূসের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও একটি গৌরবের বিষয়। বৈশ্বিক উন্নয়নে একজন বাংলাদেশি নাগরিকের অবদান আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে—এটা দেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এক বিরাট অনুপ্রেরণা।
সমাজ বদলে দিতে হলে প্রয়োজন উদ্ভাবনী চিন্তা, নৈতিক নেতৃত্ব ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। ড. ইউনূস তা করে দেখিয়েছেন, এবং বিশ্ব আজও তাঁকে শ্রদ্ধাভরে সম্মান জানাচ্ছে।