মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস পেলেন জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলাম

২৭ মে ২০২৫ তারিখে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের এপিল বিভাগ জামায়াত-e-ইসলামির সিনিয়র নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামকে ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে খালাস দেয়। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে গঠিত সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সকাল সাড়ে ৯টায় এই রায় ঘোষণা করেন। এটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (ICT-1) দেওয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আগের এপিল বিভাগের রায় বাতিল ও খালাস ঘোষণা করার বিরল ঘটনা।
আসামি পরিচিতি
- নাম: এ টি এম আজহারুল ইসলাম
- দল: বাংলাদেশ জামায়াত-e-ইসলামি
- গ্রেপ্তার: ২২ আগস্ট ২০১২, রাজধানীর মগবাজার এলাকা থেকে
- কারাবন্দি: কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার
- রাজনৈতিক পরিচিতি: মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াত-e-ইসলামির স্থানীয় শাখার সভাপতি হিসেবে সক্রিয়; পরবর্তীতে দলীয় নেতৃত্বে ওঠানামা
মূল অভিযোগ ও ICT-1 রায়
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল-১ (ICT-1) ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এ টি এম আজহারকে মানবতাবিরোধী অপরাধের পাঁচটি ধারায় দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়। অভিযোগে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর নেতৃত্বে:
- ১,২৫৬ জন হত্যা
- ১৭ জন অপহরণ
- ১৩ জন নারী ধর্ষণ
- হাজারো গৃহপালিত বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া
- বেসামরিক জনগণকে নির্যাতন এবং সম্পত্তি আনাঢ়চুনি করা।
আপিলের প্রেক্ষাপট
- শুনানির সূচনা: ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আজহারুল ইসলাম এপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন।
- প্রথম শুনানি ও বহাল রাখা: ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর, একটি অন্য বেঞ্চ আগের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সে রায়ের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।
- BSS।
- শেষ শুনানি: ২০২৫ সালের ৮ মে, রাষ্ট্রপক্ষ ও প্রতিরক্ষার যুক্তি উপস্থাপন শেষে বিচারপতিরা রায়ের জন্য আজ (২৭ মে) দিন ধার্য করে।
এপিল বিভাগে শুনানি ও রায়
বৃহস্পতিবারের (২৭ মে) রায়ে বেঞ্চের সারমর্ম:
- ICT-1 ও নিম্ন আদালতের বিচার সময়মতো তথ্য–উপাত্ত যথাযথভাবে বিবেচনা করেনি।
- “বিচারের নামে অবিচার” হয়েছে; সাক্ষ্য প্রমাণ ও অভিযুক্তের উপস্থাপন ব্যতীত রায় প্রদান আবশ্যক ছিল।
- মোট কোনো মামলা বর্তমানে কার্যকর না থাকলে আজহারুল ইসলাম অবিলম্বে মুক্তি পাবেন।
সার্বিকভাবে, “অসংশোধিত মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগ পূর্বের সব রায় বাতিল করিল”—এবং প্রথমবারের মতো যুদ্ধাপরাধ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি এভাবে খালাস পেলেন।
রায়ের বিন্যাস ও পর্যবেক্ষণ
- ন্যায়বাধীনতা: বিচারপতিরা উল্লেখ করেন, যুদ্ধাপরাধ মামলায় অভিযোগ প্রমাণের মানদণ্ড ‘সংশয়াতীত’ হওয়া জরুরি, যা ICT-1 পর্যায়ে মেনে চলেনি।
- সাক্ষ্য–প্রমাণের ত্রুটি: বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য আদালতে উল্লিখিত হয়নি বা নিশ্চিততা ছাড়াই গ্রহণ করা হয়েছে।
- প্রক্রিয়াগত অবিচার: আজহারুলের পক্ষে উপস্থাপিত নতুন তথ্য–উপাত্ত যথার্থভাবে মূল্যায়ন হয়নি।
- প্রথম এক্সপেরিয়েন্স: এই রায়ে প্রথমবারের মতো এপিল বিভাগ মানবতাবিরোধী অপরাধের মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে খালাস দিয়েছে।
প্রতিক্রিয়া
- রক্ষাকারী আইনজীবী:
- মোহাম্মদ শিশির মনির (আইনজীবী) বলেন, “আজহারুল ইসলাম দীর্ঘদিন সুস্পষ্ট তথ্য–প্রমাণের অভাবে নির্যাতিত; এই রায় আইনের বিজয়।”
- রাষ্ট্রপক্ষ:
- অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক ও প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম কিছুই মন্তব্য করতে চাননি; তবে জানানো হয়েছে, ঐক্যবদ্ধ দল বিবেচনা করবে।
- জামায়াত-e-ইসলামি:
- “জনগণের মঞ্চে জয়, সত্যের বিজয়!”—দলীয় কর্মীরা উল্লাস করেন।
- মানবাধিকার সংগঠন:
- কিছু এনজিও আশঙ্কা প্রকাশ করেছে, “যুদ্ধাপরাধ গণ্যানে সুবিচার বাধাগ্রস্ত হলে ভবিষ্যৎ ট্রাইব্যুনালের কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।”
আইনি ও সামাজিক প্রভাব
- প্রিসিডেন্ট সেট করেছিলেন: আন্তর্জাতিক অপরাধ বিচারে দেশের সুপ্রিম কোর্টের এই সিদ্ধান্ত পরের মামলায় আপিল বিভাগে নতুন মানদণ্ড স্থাপন করবে।
- ট্রাইব্যুনালের স্বচ্ছতা: ICT-1 সহ আগামী ট্রাইব্যুনালগুলোতে অবহিত হওয়া সম্ভবত আরও কঠোর সাক্ষ্য–প্রমাণ যাচাই নিশ্চিত করবে।
- রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব: জামায়াতের ভোটমঞ্চে কাজ হতে পারে; সাধারণ জনগণের মধ্যেও বিচার–বিশ্বাসে ভিন্নমত বিরাজ করতে পারে।
- মানবাধিকার সূচকে উত্থান/পতন: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ বিচারের স্বীকৃতি প্রভাবিত হতে পারে।
বিশ্লেষণ ও সমালোচনা
- ট্রাইব্যুনালের চ্যালেঞ্জ:
ICT-1 দ্রুত রায় দেওয়ার প্রসঙ্গ, সময়ের সঙ্কট ও প্রমাণাদি সংগ্রহে দুর্বলতা এভাবে প্রকাশ পেল। - আইনগত খাঁজ:
যুদ্ধাপরাধ মামলায় ‘সংশয়াতীত প্রমাণের উপর’ দোষী সাব্যস্তের নীতিমালা কীভাবে পুরনো বেঞ্চগুলো মেনে চলেছে, তা পর্যালোচিত হবে। - রাজনৈতিক চাপের সম্ভাবনা:
জামায়াত-e-ইসলামি দীর্ঘদিন হেফাজতে রাজনীতি চালিয়ে আসছে; মুক্তির রায়ে দলীয় প্রভাব কতটুকু কাজ করেছে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে পারে। - জনসাধারণের প্রত্যাশা:
অনেকেই মনে করছেন, যাদের বিরুদ্ধে জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক আদালতে অপরাধ প্রমাণিত, তাদের পুনরায় উচ্চ আদালতে রায় চ্যালেঞ্জ করাটা ‘আইনগত অধিকার’।
সুপ্রিম কোর্টের এপিল বিভাগের এই রায়ে সুস্পষ্ট হল: “বিচারে সুবিচার নিশ্চিত করতে সব স্তরে পূর্ণ তথ্য–প্রমাণ যাচাই অপরিহার্য”। জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের মুক্তি রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থায় এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা। তবে এপিল বিভাগের এই নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত পরবর্তী যুদ্ধাপরাধ মামলায় কী প্রভাব ফেলে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।