গাজীপুরে মর্মান্তিক ঘটনা: শিশুর কান্নায় ফাঁস হলো মায়ের মরদেহ, স্বামী পলাতক

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার আবদার এলাকায় ঘটে গেছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। একটি ঘর থেকে ভেসে আসা শিশুর কান্নার শব্দ যেন পুরো এলাকার কণ্ঠরোধ করে দিয়েছিল। সেই কান্নার অনুসন্ধানে গিয়ে প্রতিবেশীরা যা দেখলেন, তা কেবল মর্মস্পর্শীই নয়, বরং সমাজের গভীর বাস্তবতাকেও সামনে এনেছে।
ঘটনার শুরু: একটি অসহায় শিশুর কান্না
বুধবার সকাল পৌনে আটটার দিকে, এলাকার এক ভাড়াটে নুরুন্নাহার তার কর্মস্থল থেকে ফিরে পাশের কক্ষ থেকে বারবার শিশুর কান্নার আওয়াজ পান। শিশুর কান্নার মধ্যে ছিল আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা। কৌতূহলী হয়ে তিনি এগিয়ে গিয়ে দেখেন, দরজা খোলা। ভিতরে গিয়ে দেখতে পান, আট মাস বয়সী একটি শিশু বিছানার একপাশে কাঁপছে ও কাঁদছে। বিছানার অন্য পাশে নিথর পড়ে আছে তার মা আকলিমা আক্তারের মরদেহ।
ঘটনার তাৎক্ষণিক খবর পেয়ে স্থানীয়রা জড়ো হন এবং পুলিশকে অবহিত করা হয়। দুপুরের দিকে শ্রীপুর থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে মরদেহ উদ্ধার করে।
নিহতের পরিচয় ও পারিবারিক পটভূমি
নিহত আকলিমা আক্তার (৩০) ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা উপজেলার নিমুরিয়া গ্রামের মেয়ে। তিনি জামিরদিয়ার একটি পোশাক কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন এবং শ্রীপুরে স্বামী আদনান ইসলাম ও ছোট সন্তানকে নিয়ে ভাড়া বাসায় থাকতেন। আকলিমার তিনটি সন্তান রয়েছে; বড় দুটি সন্তান গ্রামের বাড়িতে থাকে এবং ছোট সন্তানটি তার সঙ্গেই ছিল।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আদনান ইসলাম একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত ছিলেন। তবে ঘটনার পর থেকে তার কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিবেশীরা অভিযোগ করেছেন, আদনান প্রায়ই আকলিমাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করতেন।
প্রাথমিক তদন্তে কী জানা গেছে?
শ্রীপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আবদুল বারিক বলেন, “প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, পারিবারিক কলহ থেকেই এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। আকলিমার মরদেহে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে, যা তাকে হত্যার প্রমাণ দেয়। অভিযুক্ত স্বামী ঘটনার পর থেকে পলাতক। আমরা এটি হত্যাকাণ্ড হিসেবে তদন্ত করছি এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।”
পুলিশের ধারণা, ঘটনার সময় স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো তীব্র ঝগড়া বা বিরোধ ঘটে থাকতে পারে, যার জেরে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। আকলিমার শরীরে গলা ও মুখের কাছে রক্তের চিহ্ন দেখা গেছে, যা শ্বাসরোধ বা গলাচাপা দিয়ে হত্যার ইঙ্গিত দেয়।
পারিবারিক সহিংসতার একটি নির্মম চিত্র
এই ঘটনায় আবারও সামনে এলো পারিবারিক সহিংসতার ভয়াবহ রূপ। বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য নারী ঘরে ঘরে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু শারীরিক নয়, মানসিক নিপীড়নেরও ভয়াবহ রূপ রয়েছে। অনেক সময় এমন নির্যাতনের চূড়ান্ত পরিণতিই হয় প্রাণহানি।
জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৩-৪টি নারী হত্যার ঘটনা ঘটে, যার অধিকাংশই পারিবারিক কলহের জেরে। নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বহু উদ্যোগ থাকলেও মাঠপর্যায়ে সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ
এই ঘটনার সবচেয়ে মর্মান্তিক দিক হলো আট মাস বয়সী শিশুটির করুণ পরিণতি। মায়ের মৃতদেহের পাশেই কয়েক ঘণ্টা কাটানো সেই শিশুটি এখন নিঃস্ব। একজন শিশুর মানসিকভাবে কতটা আঘাতপ্রাপ্ত হতে পারে এমন ঘটনায়, তা সহজেই অনুমেয়।
সাময়িকভাবে শিশুটিকে স্থানীয়দের সহায়তায় নিরাপদ স্থানে রাখা হয়েছে। সামাজিক কল্যাণ অধিদপ্তর, শিশু সুরক্ষা বিভাগ এবং স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সচেতন মহল।
নিহতের পরিবারের প্রতিক্রিয়া
আকলিমার ভাই শামীম জানিয়েছেন, “আমরা এমন কিছু কল্পনাও করিনি। আমার বোন প্রায়ই বলতো স্বামী তাকে মারধর করে, গালিগালাজ করে। আমরা অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি। এখন শুধু চাই, অপরাধীর কঠিন শাস্তি হোক।”
আইনি প্রক্রিয়া ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
পুলিশ জানিয়েছে, আকলিমার মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর প্রকৃত মৃত্যুর কারণ ও হত্যার ধরন আরও স্পষ্ট হবে।
এছাড়া, স্বামী আদনান ইসলামের বিরুদ্ধে শিগগিরই হত্যা মামলা দায়ের করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। তার মোবাইল ট্র্যাকিং এবং সম্ভাব্য গন্তব্যে নজরদারিও শুরু করা হয়েছে।
সামাজিক বার্তা: নির্যাতন থামান, ন্যায়ের পথে হাঁটুন
এই ধরনের ঘটনা আমাদের সমাজে বারবার ঘটছে। অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হলেও ভয় বা সামাজিক লজ্জার কারণে তা প্রকাশ করতে পারেন না। সমাজ ও রাষ্ট্রের উচিত, এমন পরিবারগুলোর প্রতি আরও মনোযোগী হওয়া। নির্যাতিতদের সুরক্ষা, পরামর্শ এবং আইনি সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা জরুরি।
গাজীপুরের শ্রীপুরে আকলিমা আক্তারের এই করুণ মৃত্যু কেবল একটি হত্যা নয়, বরং পুরো সমাজের জন্য একটি অ্যালার্ম। এটি আমাদের দেখিয়ে দেয়, ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সহিংসতার রূপ কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। একজন মা নিঃশেষ হয়ে গেলেন, আর এক নিষ্পাপ শিশু হারাল তার ভবিষ্যতের সবচেয়ে বড় আশ্রয়।