বাংলাদেশ

দিনাজপুরে ট্রাক-মাইক্রোবাস সংঘর্ষে প্রাণ গেল ৪ জনের

আজ সোমবার (১৯ মে) সকাল সাড়ে ৬টার দিকে দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার বেঙপুকুর এলাকায় ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় চারজনের প্রাণহানি হয়েছে। দিনাজপুর-পঞ্চগড় মহাসড়কে ট্রাক ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই দুজন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও দুজন মারা যান।

নিহত চারজনই ঠাকুরগাঁও জেলার বাসিন্দা এবং তাদের মধ্যে তিনজন সরকারি হিসাবরক্ষণ দপ্তরের কর্মকর্তা ছিলেন। তারা বিভাগীয় একটি প্রশিক্ষণে যোগ দিতে রংপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলেন।

নিহতদের পরিচয়

নিহতরা হলেন:

  • মানিক হোসেন (৪২) – মাইক্রোবাসচালক, ঠাকুরগাঁও রোড কলোনি এলাকার বাসিন্দা
  • দেলোয়ার হোসেন (৪৫) – হাজীপাড়া, ঠাকুরগাঁও সদর
  • ইমরুল হাসান (৪৩) – বোয়ালদাড়, বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা
  • জুলফিকার আলী (৪৫) – মালিভিটা, রানিশংকৈল উপজেলা

নিহতদের মধ্যে দেলোয়ার, ইমরুল ও জুলফিকার বিভিন্ন সরকারি হিসাবরক্ষণ অফিসে কর্মরত ছিলেন বলে স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিত করেছে।

কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সকালের দিকে মাইক্রোবাসটি ঠাকুরগাঁও থেকে রংপুরের দিকে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে বীরগঞ্জ উপজেলার বেঙপুকুর এলাকায় বিপরীত দিক থেকে আসা একটি সিমেন্টবাহী ট্রাকের সঙ্গে মাইক্রোবাসটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ট্রাকটির গতি ছিল অত্যন্ত দ্রুত এবং নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মাইক্রোবাসে সজোরে আঘাত করে। এতে মাইক্রোবাসটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং ঘটনাস্থলেই চালকসহ দুজন নিহত হন।

গুরুতর আহত অবস্থায় বাকি চারজনকে দ্রুত ঠাকুরগাঁও ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক আরও দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন। আহত অপর দুইজন চিকিৎসাধীন রয়েছেন, তবে তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানা গেছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পদক্ষেপ

বীরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল গফুর গণমাধ্যমকে জানান, “সকালে একটি ট্রাক ও মাইক্রোবাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। বিষয়টি হাইওয়ে পুলিশ তদন্ত করছে এবং প্রয়োজনীয় আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হচ্ছে।”

দশমাইল হাইওয়ে পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে এবং দুর্ঘটনায় ব্যবহৃত ট্রাকটি জব্দ করা হয়েছে। ট্রাকচালক দুর্ঘটনার পরপরই পালিয়ে যান। পুলিশ জানায়, চালককে আটকের জন্য অভিযান চালানো হচ্ছে।

প্রশিক্ষণ যাত্রায় অকালমৃত্যু

নিহত তিন কর্মকর্তা সরকারি কর্মচারী হিসেবে রংপুরে একটি বিভাগীয় প্রশিক্ষণ কর্মশালায় অংশগ্রহণের জন্য যাচ্ছিলেন। সরকারি দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে এমন করুণ মৃত্যুতে পরিবার, সহকর্মী এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

ঠাকুরগাঁও জেলা হিসাবরক্ষণ অফিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, “এটা শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, বরং আমাদের তিনজন অভিজ্ঞ ও সৎ কর্মকর্তাকে হারানোর মতো অপূরণীয় ক্ষতি। তারা সকলে সরকারি দায়িত্বে ছিলেন এবং প্রশিক্ষণে যোগদান করতে যাচ্ছিলেন।”

সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির উদ্বেগজনক চিত্র

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিদিনকার ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু ২০২৪ সালেই সারাদেশে প্রায় ৫ হাজারের বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৬ হাজারেরও বেশি মানুষ, আহত হয়েছেন আরও কয়েকগুণ। ট্রাক ও ভারী যানবাহনের বেপরোয়া গতি, অনিয়ন্ত্রিত ওভারটেকিং এবং চালকদের অপ্রশিক্ষিত ও অবসন্ন অবস্থা এই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও জেলার মহাসড়কগুলোতে নিরাপত্তা জোরদার, স্পিড ব্রেকার স্থাপন ও নিয়মিত পুলিশ টহলের দাবি তুলেছেন স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া

বেঙপুকুর এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, “এই সড়কে প্রতিদিনই আমরা ট্রাকের বেপরোয়া গতির শিকার হই। আজকের দুর্ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কতটা ঝুঁকিপূর্ণ আমাদের এই মহাসড়ক। প্রশাসনের উচিত দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।”

নিহতদের পরিবারে শোকের ছায়া

নিহতদের পরিবারে এখন শোকের মাতম। সকালেই পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যারা সরকারি দায়িত্ব পালনে রওনা হয়েছিলেন, তারা ফিরলেন লাশ হয়ে। নিহতদের পরিবার দ্রুত লাশ হস্তান্তর ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন। ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসন ও সংশ্লিষ্ট দপ্তর তাদের পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাস দিয়েছে।

কেবল তদন্ত নয়, প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ

দিনাজপুরের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আবারও প্রমাণ করল যে, কেবল দুর্ঘটনার পর তদন্ত করে দায়সারা নয়, বরং দেশের মহাসড়ক ব্যবস্থাপনায় কাঠামোগত পরিবর্তন ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত সবাই আজ সড়কে ঝুঁকির মুখে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে প্রতিদিনই কেড়ে নেবে আরও অমূল্য জীবন।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button