রমনা বোমা হামলা মামলায় ২ জনের যাবজ্জীবন, ৯ জনের ১০ বছরের কারাদণ্ড

২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল, বাংলা নববর্ষের পহেলা বৈশাখের সকালের আলোয় ঢাকার রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ঘটে ওঠে এক মর্মান্তিক সন্ত্রাসী ঘটনার চিত্র। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে ছায়ানটের মঞ্চ সংলগ্ন জমায়েত মানুষের ভিড়ের মাঝে একের পর এক দুটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। প্রথম বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই ৯ জন নিহত হন, পরে হাসপাতালে আরও একজনের মৃত্যু হয়। আহত হন শতাধিক নারী-পুরুষ, তরুণ-শিক্ষার্থী, বয়স্ক নাগরিক—মধ্য দিয়ে গড়িয়ে যায় বেদনার এক কালো তীর্যক সূচনা।
সাংস্কৃতিক স্থানে হামলার প্রভাব
বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক জগতের প্রাণকেন্দ্র ছায়ানট যেন হয়ে উঠেছিল উন্মুক্ত আনন্দঘন বিনোদন কিংবা নববর্ষ উদযাপনের প্রতীক। সেখানে এমন হত্যাযজ্ঞ আয়োজন অনেকেই বিশ্বাসই করতেন না। বোমা বিস্ফোরণের পর ঢাকার রাস্তায় ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক আর অচেনা ভয়ের পারদ। পরের দিন থেকে মাঝরাত জেগে স্বজনদের শোচনীয় সান্নিধ্যে কাটিয়ে দিতে হয়েছে অসংখ্য পরিবারকে।
মামলার তদন্ত ও বিচারিক পর্যায়
মামলা দায়ের এবং প্রাথমিক তদন্ত
হামলা হওয়ার দিনই নিলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ি থেকে সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ রমনা থানায় দুটি মামলা করেন: একটিতে ‘হত্যা’, অন্যটিতে ‘বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ অনুযায়ী অভিযোগ। তদন্ত শাখা (DB) তদন্তের দায়িত্ব নেয় এবং মৃতদেহ-ভগ্নাংশ, সিসিটিভি ফুটেজ, দাহ্যদ্রব্যের নমুনা সংগ্রহ করে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য পাঠায়।
চার্জশিট দাখিল ও সাক্ষ্যগ্রহণ
প্রায় সাত বছর তদন্তের পর ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর খুনের মামলাসহ দুইটি মামলায় ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এরপরে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শুরু হয় ট্রায়াল—সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক, প্রমাণাদি যাচাই, কৌঁসুলি-নারীর দ্বিমত আড়াই বছর ধরে বিচারিক আদালতে চলে।
প্রথম রায় (২০১৪)
২৩ জুন ২০১৪-এ ঢাকার সুনামগঞ্জ রোডের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল রায় ঘোষণা করে: ৮ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বাকিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তালিকায় ছিলেন হুজি-বি প্রধান মাওলানা তাজউদ্দিন ও তার সহকারী শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল।
হাইকোর্টে আপিল ও চূড়ান্ত রায়
মৃত্যুদণ্ড রেফারেন্স ও ফৌজদারি আপিল
প্রাথমিক রায় ঘোষণার পর রাষ্ট্রপক্ষ মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বজায় রাখার দাবি জানায় ‘ডেথ রেফারেন্স’ করেন। অপরদিকে, আসামিপক্ষ ফৌজদারি আপিলে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তন ও সাজা কমানোর আবেদন করেন।
হাইকোর্ট বেঞ্চের পর্যালোচনা
১৩ মে ২০২৫-এ বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম এবং বিচারপতি নাসরিন আক্তার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ বিষয়ের সময়কাল, সাক্ষ্য-প্রমাণ, সংশ্লিষ্ট আইনপন্থী যুক্তি বিবেচনায় নিয়ে রায় ঘোষণা করেন। রায়ের মূল বিষয়বস্তু—
- মাওলানা তাজউদ্দিন ও শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল
- মৃত্যুদণ্ড বাতিল, জাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
- অন্যান্য ৯ জন আসামি
- মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ড প্রত্যাহার, ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং প্রতি জনে ৫০,০০০ টাকা জরিমানা।
বেঞ্চের মন্তব্য
রায়ে বেঞ্চ উল্লেখ করেন যে, “রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের উপস্থাপিত যুক্তি, সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং দীর্ঘ বিচার-বিশ্লেষণপূর্বক পরিমিত পরিমাণে সাজা হ্রাস করা হয়েছে। ন্যায়বিচারের স্বার্থে সময় ও পরিস্থিতি বিবেচনায় রাখা হয়েছে।”
প্রধান আসামিদের পরিচিতি ও প্রভাব
মাওলানা তাজউদ্দিন
হরতকুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশের (হুজি-বি) শীর্ষ নেতা তাজউদ্দিন এর আগে বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত ছিলেন। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, তিনি হামলার পরিকল্পনাকারী। তার অধীনে দেশের একাধিক সাংস্কৃতিক ও পাবলিক স্থানে বোমা হামলার নেপথ্য পরিচালনা হয় বলে সন্দেহ।
শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল
হামলার সময় মূল পরিকল্পনায় জুয়েলের সমর্থন ও ঐতিহাসিক দণ্ড-বিধির যোখিমমূলক ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ্য। প্রাথমিক তদন্তে তার ফোন কল যোগাযোগ, আর্থিক লেনদেন ও অতীত সন্ত্রাসী কার্যকলাপের রেকর্ড পর্যালোচনা করে উচ্চ আদালতে তা প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়।
দীর্ঘ বিচারিক সময়পথের জটিলতা
বোমা হামলার মামলার তদন্ত শুরু থেকে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা হতে মোট লেগেছে ২৪ বছর। এর মধ্যে–
- ৭ বছর তদন্ত
- ৫ বছর সাক্ষ্য-প্রক্রিয়া ও বিচারিক রায়
- ১২ বছর উচ্চ আদালতে আপিল ও রেফারেন্স নিষ্পত্তি
আইনজীবীরা মনে করেন, বিচারিক কাজের এই দীর্ঘসূত্রতা ‘ন্যায়বিচার বিলম্ব’ ঘটায়। বিষয়টি সঠিক ও দ্রুত বিচারের মূলনীতির বিপরীত চলে যায়, যা বাদী, অভিযুক্ত উভয়ের জন্যই হতাশার কারণ।
ভুক্তভোগী ও সাংস্কৃতিক মহলের প্রতিক্রিয়া
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর মন্তব্য
এক সিনিয়র রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সিগনাল বিডিকে বলেন,
“আমরা আশা করেছিলাম, উচ্চ আদালত প্রাথমিক রায় বজায় রাখবে। হাইকোর্টের ব্যাখ্যার প্রতি সম্মান রেখেই পরবর্তী ধাপে আপিল বিভাগে যাব।”
আসামিপক্ষের আইনজীবীর প্রতিক্রিয়া
এক আসামি পক্ষে মহামান্য আদালতে উপস্থিত আইনজীবী জানিয়েছেন,
“দীর্ঘ দুই দশকের লড়াই শেষে আদালত ন্যায়বিচার করেছে। রায় মেনে নেয়া হচ্ছে, তবে আপিল বিভাগে আমরা অন্যায্যতার বিষয়টি তুলে ধরবো।”
সাংস্কৃতিক সংগঠনের উদ্বেগ
ছায়ানট ও অন্যান্য সাংস্কৃতিক সংগঠন এ বিষয়ে সমবেদনাপূর্ণ ভঙ্গিতে বলেছে,
“এই হামলা শুধু নিরীহ দর্শকদের নয়, আমাদের শিল্প-সাংস্কৃতিক জীবনের মূলকে আঘাত করে। এ রায় যদি যথেষ্ট কঠোর না হয়, তবে ভবিষ্যতে সন্ত্রাসীদের সতর্ক করার জন্য আরও শক্তিশালী ব্যবস্থার প্রয়োজন।”
পরবর্তী ধাপ: আপিল বিভাগ
হাইকোর্টের রায় যদি রাষ্ট্রপক্ষের সন্তুষ্টি নেয় না, তবে তারা শীর্ষ আদালত ‘আপিল বিভাগ’-তে চ্যালেঞ্জ করতে পারবেন। অন্যদিকে, আসামিরাও যদি সাজা আরও কমানোর দাবি জানাতে চান, তাদেরও আপিলের সুযোগ রয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আপিল বিভাগে বিষয়টি পুনরায় আলোচনায় আসতে পারে; তবে হাইকোর্টের ‘সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যুক্তিসম্মত ভাবনা’ আপিল পর্যায়েও প্রভাব রাখবে।
রমনা বটমূল ছায়ানট বর্ষবরণে সংঘটিত বোমা হামলা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে এক কালো চিহ্ন। দীর্ঘ ২৪ বছরের আইনি লড়াই শেষে হাইকোর্টের চূড়ান্ত রায় হয়তো তৎকালীন স্মৃতিকে মুছে ফেলতে পারবে না, তবে আইন-শৃঙ্খলার অটল প্রয়োগের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সকরুণ বার্তা দেবে। তাজউদ্দিন ও জুয়েলের যাবজ্জীবন, বাকি ৯ জনের ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানা—আইনের শাসনের মধ্যে এই রায়ই এক ইতিবাচক চর্চা হিসেবে রয়ে যাবে।