গুজরাট থেকে উড়োজাহাজ-লঞ্চে করে চোখ বেঁধে আনা হয়েছে, জানালেন ভুক্তভোগীরা

ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক চোখ বেঁধে উড়োজাহাজ ও নৌযানে করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া ৭৮ জন নাগরিককে সুন্দরবনের গভীর চরে ফেলে যাওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তাঁদের অধিকাংশই নড়াইল জেলার বাসিন্দা এবং দীর্ঘদিন ধরে ভারতের গুজরাটে অবস্থান করছিলেন। সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে ‘পুশব্যাক’ করার এই ঘটনায় চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছেন ভুক্তভোগীরা।
সুন্দরবনের চরে উদ্ধার, পরে থানায় হস্তান্তর
গত শুক্রবার (৯ মে) ভোররাতে পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে এই ৭৮ জনকে রেখে যায় বিএসএফ সদস্যরা। শনিবার রাত ১১টার দিকে বন বিভাগ তাঁদের উদ্ধার করে বাংলাদেশ কোস্টগার্ডের কাছে হস্তান্তর করে। পরে রোববার (১১ মে) রাতে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় তাঁদের রাখা হয়।
শ্যামনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রথম আলোকে জানান, উদ্ধার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশের নাগরিক এবং ৩ জন ভারতীয়। বর্তমানে তাঁদের সবাইকে থানার দোতলায় রাখা হয়েছে। নড়াইল জেলার ৬৩ জন, বাকি ৮ জনের বাড়ি সাতক্ষীরা, যশোর, বরিশাল ও ঢাকা জেলায়।
মানবেতর অবস্থায় ফিরে আসা
ভুক্তভোগীদের একজন, নড়াইলের কালিয়ার মাধবপাশা গ্রামের হারুন শেখ (৬০) জানান, তিনি ৩৭ বছর ধরে গুজরাটের সুরাট বস্তিতে ভাঙারির ব্যবসা করতেন। ২৬ এপ্রিল হঠাৎ করেই ভারতীয় ক্রাইম পুলিশ সুরাটের বস্তিতে অভিযান চালিয়ে ৫০০-৬০০ জনকে আটক করে। তাঁদের সামনে বস্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় এবং পরে পুলিশ ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। নারী, পুরুষ ও শিশুদের আলাদাভাবে ভাগ করে রাখা হয়। এরপর তাঁদের একটি দলে করে চোখ বেঁধে অজানা স্থানে নেওয়া হয়।
“আমাদেরকে দুপুরে শুধু একটি রুটি, অন্য সময় দুটি বিস্কুট দেওয়া হতো,” বলেন হারুন। “৬ মে চোখ বেঁধে উড়োজাহাজে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়, সেখান থেকে সন্দেহখালী সীমান্তে এবং পরে ৯ মে ভোরে বড় একটি লঞ্চে করে সুন্দরবনের গহিনে ফেলে যায়।”
নির্যাতনের চিহ্ন ও শারীরিক দুরবস্থা
বন বিভাগের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক মশিউর রহমান জানান, “উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের অনেকেই না খেয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। একজনের হাত ভাঙা ছিল, আরও কয়েকজনের শরীরে নির্যাতনের স্পষ্ট চিহ্ন ছিল। আমরা স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় খাবার, স্যালাইন ও বিশুদ্ধ পানি পৌঁছে দিই।”
ভুক্তভোগীরা জানান, তাঁরা ১৫ দিন ধরে একটি পুলিশ ক্যাম্পে নির্যাতনের শিকার হন। গন্তব্য সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি, এমনকি পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি।
পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া
নড়াইলের বিষ্ণুপুর গ্রামের হাসান শেখ, লোহাগড়ার চান্দেরচরের শিহাত হোসেন, এবং খুলনার তেরখাদার শাখায়েত মোল্যা জানান, তাঁরা গুজরাটে কাজ করতেন এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা সুরাট বস্তিতে বাস করতেন। পুলিশ তাঁদের পরিবারকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা তাঁরা জানেন না। সন্তানেরা কোথায় আছে তা নিয়েই এখন তাঁদের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ।
৩ ভারতীয় নাগরিক, মামলা দায়ের
উদ্ধারকৃতদের মধ্যে তিনজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন—আবদুর রহমান (২০), হাসান শাহ (২৪) এবং সাইফুল শেখ (১৯)। তাঁদের পৈতৃক বাড়ি নড়াইলের হলেও জন্ম ও বেড়ে ওঠা গুজরাটের বস্তিতেই হয়েছে। শ্যামনগর থানার ওসি জানান, এঁদের বিরুদ্ধে ‘অবৈধভাবে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ’-এর অভিযোগে কোস্টগার্ড মামলা দায়ের করেছে।
প্রশাসনের পরবর্তী পদক্ষেপ
প্রশাসন জানিয়েছে, বাংলাদেশি ৭৫ জনের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। স্বজনরা এলে তাঁদের কাছে হস্তান্তর করা হবে। অপরদিকে, ভারতীয় নাগরিকদের বিষয়ে আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থীভাবে নাগরিকদের জোরপূর্বক সীমান্তচ্যুত করার বিষয়টি সামনে এসেছে। বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে লোকজনকে ফেলে যাওয়ার ঘটনাকে মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হিসেবে দেখছেন অনেকে। সরকারি পর্যায় থেকে এখনো পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।