বাংলাদেশ

রেল সংযোগে ব্যাঘাত, যাত্রী দুর্ভোগ চরমে

দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান রেল সংযোগপথে এক বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি হলো শুক্রবার রাতে। ঢাকা থেকে খুলনাগামী ‘জাহানাবাদ এক্সপ্রেস’ ভাঙ্গা জংশনে লাইনচ্যুত হওয়ার ফলে প্রায় ১৫ ঘণ্টা বন্ধ ছিল দক্ষিণবঙ্গগামী রেল চলাচল। ফলে বিপাকে পড়েন শত শত যাত্রী। এ ঘটনায় রেলের পয়েন্টম্যান নজরুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটিও গঠন করেছে।

‍কি ঘটেছিল শুক্রবার রাতে?

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার (৯ মে) রাত ৯টার দিকে জাহানাবাদ এক্সপ্রেস ট্রেনটির ইঞ্জিনসহ দুটি কোচ লাইনচ্যুত হয় ভাঙ্গা জংশনের কাছে। এতে ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের একমাত্র রেল সংযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ট্রেনটি তখন খুলনার দিকে যাচ্ছিল এবং পদ্মা সেতু হয়ে চলছিল।

ঘটনার সময় ভাঙ্গা বামনকান্দা রেল ফাঁড়ির ইনচার্জ খায়রুজ্জামান সিকদার জানান, দুর্ঘটনার পরপরই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় এবং যাত্রীদের নিরাপদে সড়কপথে তাদের গন্তব্যে পাঠানো হয়।

‍সিগন্যাল পরিবর্তনের ‘ভুল সিদ্ধান্ত’, বরখাস্ত পয়েন্টম্যান

ঘটনার জন্য রেলওয়ের পাকশী বিভাগীয় কর্মকর্তা হাচিনা খাতুন প্রাথমিকভাবে পয়েন্টম্যানের দায়ের কথা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন,

“পয়েন্টম্যান নজরুল ইসলাম কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই সিগন্যাল পরিবর্তন করেন, যার ফলে দুর্ঘটনাটি ঘটে। তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।”

দায়িত্ব পালনে অবহেলার কারণে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটনে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে রেল কর্তৃপক্ষ।

‍মেরামতের কাজ চলেছে রাতভর

ট্রেনটি লাইনচ্যুত হওয়ার পর রাত থেকেই উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়। দুটি বড় ক্রেন এনে লাইনে ফিরে আনা হয় লাইনচ্যুত কোচ ও ইঞ্জিন। সারারাত এবং শনিবার সকাল পর্যন্ত চলে রেললাইন মেরামতের কাজ। দুপুরের পর ধীরে ধীরে চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে।

তবে খুলনা ও বেনাপোলগামী ট্রেনের সিডিউল বাতিল করতে হয়েছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। অন্য রুটে বিকল্প চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়।

‍ট্রেনযাত্রীদের দুর্ভোগ: কেউ ফিরে গেছেন, কেউ সড়কে

দুর্ঘটনার ফলে তাৎক্ষণিকভাবে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রাতভর অপেক্ষায় ছিলেন যাত্রীরা। অনেকেই হতাশ হয়ে ট্রেন ছাড়াই ফিরে যান। কারো কারো গন্তব্যে পৌঁছাতে বিকল্প হিসেবে সড়কপথে বাসে রওনা দিতে হয়।

এ বিষয়ে ফরিদপুর থেকে আসা এক যাত্রী বলেন,

“আমরা খুলনায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ ট্রেন থেমে যায়, পরে শুনি লাইনচ্যুতি হয়েছে। অনেক কষ্টে একটা বাসে উঠে রাতে রওনা হই।”

‍রেলওয়ের বারবার অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন

বাংলাদেশ রেলওয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপক সেবা সম্প্রসারণ করেছে। কিন্তু একের পর এক দুর্ঘটনায় যাত্রী নিরাপত্তা ও রেল পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন,

“নতুন অবকাঠামো তৈরির পাশাপাশি পুরনো সিস্টেমের দক্ষতা বাড়াতে হবে। শুধু বড় প্রকল্প নয়, দৈনন্দিন পরিচালন ব্যবস্থাও গুরুত্ব পেতে হবে।”

‍দ্রুত তদন্ত দাবি যাত্রী সংগঠনের

এই দুর্ঘটনা রেল ব্যবস্থাপনায় নজরদারির ঘাটতির প্রমাণ বলে মনে করছে যাত্রী অধিকার সংগঠনগুলো। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে,

“বারবার সিগন্যাল ত্রুটি বা পয়েন্টম্যানের ভুলের কারণেই দুর্ঘটনা হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।”

‍দায়িত্বশীলদের জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে সমস্যা থাকবে

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রেল কর্মকর্তা বলেন,

“সিগন্যাল সিস্টেমে ভুল হয়ে থাকলে, সেটি শুধু পয়েন্টম্যানের নয়। দায়িত্বে থাকা সুপারভাইজার বা অপারেশন ইনচার্জকেও জবাবদিহি করতে হবে। নাহলে ভবিষ্যতে বড় বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব হবে না।”

নতুন রেল সংযোগের সুবাদে পদ্মা সেতু হয়ে দক্ষিণবঙ্গের সঙ্গে ঢাকার ট্রেন যোগাযোগ এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে একটি মানবিক ভুলেই ১৫ ঘণ্টার বিভ্রাট যাত্রীদের পাশাপাশি রেলওয়ের বিশ্বাসযোগ্যতাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এখন দেখার বিষয়, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন কী আসে, এবং কত দ্রুত রেল কর্তৃপক্ষ কার্যকর সিদ্ধান্ত নেয়—যেন ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button