গাজীপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ ৫ জনের সবাই মারা গেলেন

গাজীপুরের জয়দেবপুরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে একই পরিবারের পাঁচ সদস্যের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। ঢাকার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে একে একে মৃত্যুর কাছে হার মানেন মা, শিশু সন্তান, অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ পাঁচজন। সর্বশেষ মারা যায় ১০ বছর বয়সী শিশু তানজিলা।
ঘটনার বিবরণ: কীভাবে ঘটল বিস্ফোরণ
বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে গত শনিবার (২৭ এপ্রিল) সন্ধ্যা ৭টার দিকে, গাজীপুর সিটি করপোরেশনের জয়দেবপুর থানার মোগলখাল এলাকায়। একটি বাড়ির রান্নাঘরে থাকা গ্যাস সিলিন্ডারে হঠাৎ করে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো এলাকা। মুহূর্তেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে ঘরের ভেতরে, যেখানেই ছিলেন পরিবারের পাঁচজন সদস্য।
দগ্ধদের পরিচয় ও মৃত্যু
বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে যাঁরা মারা গেছেন, তাঁরা সবাই একে অপরের আত্মীয় ও একই পরিবারের সদস্য:
- সিমা আক্তার (৩০) – শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ, মারা যান ২৮ এপ্রিল সকালে।
- তাসলিমা বেগম (৩০) – পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন, দগ্ধ হন ৯০ শতাংশের বেশি, মারা যান ২৯ এপ্রিল।
- আয়ান (১) – তাসলিমার শিশু পুত্র, মারা যায় ২৭ এপ্রিল রাতেই।
- পারভিন আক্তার (৩৫) – মারা যান ৪ মে সকালে।
- তানজিলা (১০) – তাসলিমার কন্যা, মারা যায় ৪ মে রাতে, শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।
এই মর্মান্তিক ঘটনার খবর নিশ্চিত করেছেন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. শাওন বিন রহমান।
চিকিৎসা চললেও শেষরক্ষা হয়নি
দগ্ধ পাঁচজনকেই দুর্ঘটনার রাতেই রাত ১০টা ৪৫ মিনিটের দিকে ঢাকায় জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। তাদের ভর্তি করা হয়েছিল ইনস্টিটিউটের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিট (এইচডিইউ)-তে। সবারই দেহের ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত পুড়ে গিয়েছিল। ডাক্তাররা চেষ্টা করলেও কাউকেই বাঁচানো যায়নি।
বিস্ফোরণের কারণ নিয়ে তদন্ত চলছে
গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণ এখনো নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি। তবে স্থানীয় সূত্র জানায়, সিলিন্ডারে গ্যাস লিক হয়ে ঘরে জমে গিয়েছিল। কেউ রান্না করতে গিয়ে আগুন ধরানোর সময় ঘটে এই ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ঘটনাটি তদন্ত করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এবং স্থানীয় প্রশাসন।
গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে অসচেতনতা বিপজ্জনক
বাংলাদেশে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ একটি বড় জননিরাপত্তার ঝুঁকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরনো, মেরামত না করা বা অবৈধভাবে রিফিল করা সিলিন্ডার থেকে প্রায়ই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নিচের বিষয়গুলো মানলেই এমন দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব:
- মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার ব্যবহার না করা
- নিয়মিত লিক চেক করা
- রান্নাঘর যেন পর্যাপ্তভাবে বায়ু চলাচলের উপযোগী হয়
- চুলা জ্বালানোর আগে গ্যাসের গন্ধ থাকলে সতর্ক থাকা
এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় কী?
এমন মর্মান্তিক মৃত্যু রোধে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন:
- সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর তদারকি করতে হবে—বিশেষ করে অবৈধ ও মানহীন গ্যাস সিলিন্ডার উৎপাদন ও সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে।
- সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে জনসাধারণের মধ্যে—কীভাবে গ্যাস সিলিন্ডার নিরাপদে ব্যবহার করতে হয়, তা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার বাড়াতে হবে।
- লোকাল পর্যায়ে প্রশিক্ষণ ও অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকা জরুরি, যেন দুর্ঘটনার পর প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
শোকাহত পরিবার, প্রতিবেশীরা বলছেন যা
মোগলখাল এলাকার বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, দুর্ঘটনার পর থেকেই গোটা এলাকা শোকের ছায়ায়। প্রতিবেশীদের একজন বলেন, “আমরা আগুন নিভাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু মুহূর্তেই ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এমন মৃত্যু সহ্য করা যায় না।”
একটি ছোট্ট ভুল বা অবহেলার পরিণতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে—গাজীপুরের মোগলখাল এলাকার এই ঘটনা তার নির্মম উদাহরণ। একই পরিবারের পাঁচজনের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দেয়—গ্যাস সিলিন্ডারের মতো ঝুঁকিপূর্ণ জিনিস ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।
এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে আমাদের প্রয়োজন সচেতনতা, সরকারি তদারকি, এবং জরুরি সময়ে দ্রুত সাড়া দেওয়ার সক্ষমতা। প্রতিটি প্রাণই অমূল্য—এমন মৃত্যু আর না হোক, এই হোক আমাদের প্রার্থনা।