সীমান্তে ‘ভুলে পা ফেলায়’ আটকে পড়া দুই বাংলাদেশির ৮ ঘণ্টার বন্দিত্ব

লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার গাঠিয়ারভিটা সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের হাতে আটক দুই বাংলাদেশিকে ৮ ঘণ্টা পর বিজিবির কাছে ফেরত দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার (২ মে) দিবাগত রাত দুইটার দিকে এই হস্তান্তর কার্যক্রম সম্পন্ন হয়।
আটক দুই ব্যক্তি হলেন বগুড়ার মহাস্থান এলাকার সাজেদুল ইসলাম (২০) এবং তাঁর ১৬ বছর বয়সী ভাগনে, যাঁর বাড়ি পাটগ্রামেই। তাঁদের ভারতের কোচবিহার জেলার গোমতী ক্যাম্পের বিএসএফ সদস্যরা আটক করেন।
কীভাবে ঘটল ঘটনা?
বিজিবি সূত্র জানিয়েছে, গতকাল (শুক্রবার) দুপুরে সাজেদুল ইসলাম ও তাঁর ভাগনে সীমান্তঘেঁষা একটি চা–বাগানে বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁরা সেখানে ছবি তোলার সময় ভুলবশত শূন্যরেখা অতিক্রম করে প্রায় ২০ থেকে ২৫ গজ ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েন।
ঠিক তখনই কোচবিহার জেলার ৯৮ বিএসএফ ব্যাটালিয়নের গোমতী ক্যাম্প থেকে পাঠানো টহল দল তাঁদের আটক করে। তাৎক্ষণিকভাবে বিএসএফ সদস্যরা তাঁদের হেফাজতে নেয় এবং জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে।
বিজিবির দ্রুত পদক্ষেপ: পতাকা বৈঠকের আয়োজন
ঘটনার খবর পেয়ে পাটগ্রামের ধবলসুতি বিজিবি ক্যাম্পের কমান্ডার নায়েব সুবেদার মোক্তার হোসেন বিএসএফের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করেন। এরপর দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে পতাকা বৈঠকের আয়োজন করা হয়।
বিকেলে বৈঠকের মাধ্যমে আলোচনা শুরু হয় এবং রাত ২টার দিকে, অর্থাৎ আট ঘণ্টা পর, বুড়িমারী স্থলবন্দরের অভিবাসন চেকপোস্টের মাধ্যমে দুই বাংলাদেশিকে বিজিবির হাতে তুলে দেওয়া হয়।
পাটগ্রাম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) জিল্লুর রহমান ঘটনাটির সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
সীমান্তে শূন্যরেখা পেরনো কি ফৌজদারি অপরাধ?
সীমান্তে শূন্যরেখা অতিক্রম করাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে অনিচ্ছাকৃত প্রবেশ, বিশেষ করে সাধারণ মানুষ বা পর্যটকদের ক্ষেত্রে, অনেক সময় কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান হয়ে থাকে। এই ঘটনায়ও কূটনৈতিক সৌহার্দ্য বজায় রেখেই দ্রুত হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সীমান্ত এলাকাগুলোর বিভ্রান্তিকর সীমারেখা, অপ্রশিক্ষিত সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা, কিংবা সীমান্তে পর্যাপ্ত চিহ্ন না থাকার কারণে এমন ভুল প্রায়ই ঘটে থাকে।
পরিবার ও স্থানীয়দের প্রতিক্রিয়া
আটক হওয়ার খবর পাওয়ার পর সাজেদুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা দুশ্চিন্তায় পড়ে যান। ভাগনের বাড়ির সদস্যরাও উৎকণ্ঠায় ছিলেন। তাঁরা বিজিবির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন এবং হস্তান্তরের খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন।
স্থানীয় বাসিন্দা মো. লতিফ বলেন, “সীমান্তে বেড়াতে গিয়ে এরকম ঘটনা দুঃখজনক। ভাগ্য ভালো যে বিজিবি দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে।”
বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে বর্তমান সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী — বিজিবি ও বিএসএফ — উভয়ের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ ও পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সীমান্ত নিরাপত্তা, অনুপ্রবেশ, চোরাচালান এবং সাধারণ ভুলে সীমান্ত অতিক্রমের মতো বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে পৌঁছানো হয়।
বিগত বছরগুলোতে সীমান্ত হত্যা বা গুলি বর্ষণের ঘটনায় দুই দেশের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হলেও সাম্প্রতিক সময়ে কূটনৈতিক স্তরে উভয় দেশের মধ্যে সহযোগিতার মনোভাব বৃদ্ধি পেয়েছে।
সীমান্তে সচেতনতা ও সতর্কতার প্রয়োজনীয়তা
এই ঘটনাটি আবারও মনে করিয়ে দেয় যে সীমান্ত এলাকায় পর্যটন বা সাধারণ চলাচলের সময় অতিরিক্ত সতর্কতা জরুরি। বিশেষ করে শূন্যরেখা সংলগ্ন এলাকাগুলিতে স্পষ্ট সীমানা নির্ধারণ, সাইনবোর্ড, সতর্কতা চিহ্ন এবং স্থানীয় প্রশাসনের নির্দেশনা মেনে চলা অত্যন্ত প্রয়োজন।
বিজিবি ও বিএসএফ উভয়ের পক্ষ থেকেই সীমান্তবর্তী জনগণকে নিয়মিত সচেতন করার কার্যক্রম আরও বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।
লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্তে দুই বাংলাদেশির শূন্যরেখা পেরিয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়া এবং আট ঘণ্টার মধ্যে তাঁদের সুস্থভাবে ফেরত আসা—এই পুরো ঘটনা দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কৌশলী কূটনৈতিক সমন্বয়ের একটি উদাহরণ। এ ঘটনা ভবিষ্যতে আরও সক্রিয় এবং মানবিক সহযোগিতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলে মনে করছেন অনেকে।
তবে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে সাধারণ মানুষকে আরও সচেতন হতে হবে, এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকেও সীমান্ত এলাকাগুলিতে পর্যাপ্ত সতর্কবার্তা ও নজরদারি বাড়ানো উচিত।