বাংলাদেশ

ডিসেম্বরে নির্বাচন সামনে রেখে সংস্কার কার্যক্রমে গতি চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

আগামী ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে চলমান সংবিধান ও রাজনৈতিক সংস্কার কার্যক্রম আরও দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস

শনিবার (১২ এপ্রিল) বিকেলে তাঁর সরকারি বাসভবন ‘যমুনা’-তে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে তিনি এই আহ্বান জানান। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এবং সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার। এছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য গঠন) মনির হায়দার সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে?

বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি ও সদস্য চলমান সংস্কার কার্যক্রমের অগ্রগতি সম্পর্কে চেয়ারম্যান ড. ইউনূসকে অবহিত করেন। তাঁরা জানান, বিভিন্ন খাতে গঠিত সংস্কার কমিশনের সুপারিশসমূহ নিয়ে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে আলোচনা চলছে।

এখন পর্যন্ত মোট ৮টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাদা করে আলোচনা সম্পন্ন হয়েছে, এবং আগামী বৃহস্পতিবার বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সময়সূচি নির্ধারিত রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ সব প্রধান দলের সঙ্গে প্রস্তাবিত সংস্কার বিষয়ক পরামর্শ শেষ হওয়ার পরেই কমিশন একটি সমন্বিত সুপারিশ পেশ করবে।

সংস্কার নিয়ে জনমত যাচাই ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি

বৈঠকে জানানো হয়, সংস্কার কার্যক্রমের অংশ হিসেবে জনমত যাচাই ও সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:

  • জনমত জরিপ
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার
  • টাউনহল বৈঠক
  • বিশ্ববিদ্যালয় ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে আলোচনা সভা

এই কর্মসূচিগুলোর মাধ্যমে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য সংস্কার রূপরেখা তৈরি করাই কমিশনের অন্যতম লক্ষ্য বলে জানানো হয়েছে।

প্রধান উপদেষ্টার বার্তা: সময় খুবই সীমিত

বৈঠকে অধ্যাপক ড. ইউনূস স্পষ্ট করে বলেন, “নির্বাচনের দিনক্ষণ একবার নির্ধারিত হলে সংস্কার কার্যক্রম পিছিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকবে না। তাই এখনই প্রয়োজন বাস্তবভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও সময়োপযোগী সংস্কারকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া।”

তিনি আরও বলেন, “আমরা চাই একটি গ্রহণযোগ্য, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন হোক। তার জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার একান্ত প্রয়োজন। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছে—এখন আমাদের সবার দায়িত্ব দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া।”

ঐকমত্য কমিশনের কাজ কী?

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গত বছর গঠিত হয় দেশে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে। এ কমিশন মূলত কাজ করছে চারটি প্রধান খাতে:

  1. নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার
  2. সংবিধানিক কাঠামো ও বিচারিক নিরপেক্ষতা
  3. রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থায়ন ও জবাবদিহিতা
  4. গণমাধ্যম স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের সুরক্ষা

প্রত্যেকটি খাতেই বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে উপকমিটি কাজ করছে এবং ইতোমধ্যে প্রাথমিক সুপারিশমালা তৈরি হয়েছে।

চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে বর্তমানে রাজনৈতিক পরিবেশ উত্তপ্ত। ২০২৪ সালের শেষে একটি অংশগ্রহণহীন নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসায়, বিরোধী দলগুলোর মধ্যে গণআন্দোলন ও নির্বাচন ঘিরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে

এমন প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় গঠিত হয় ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’। এই কমিশনের কাজই হলো সকল পক্ষকে নিয়ে এমন একটি রূপরেখা তৈরি করা যা আগামী নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য ও স্থিতিশীল করতে পারে

বিদেশি পর্যবেক্ষক ও উন্নয়ন অংশীদারদের দৃষ্টি

এই সংস্কার প্রক্রিয়া শুধু দেশের জনগণের কাছেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন উন্নয়ন অংশীদার ইতোমধ্যেই এই কমিশনের কাজকে গুরুত্বপূর্ণ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে।

জাতিসংঘের রাজনৈতিক মিশন বলেছে, “বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে এই ধরনের একটি কমিশন সময়োপযোগী উদ্যোগ। আমরা আশা করি, এটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক অগ্রগতির পথ সুগম করবে।”

রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ

এখন পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক দল কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছে:

  • জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)
  • গণফোরাম
  • বিকল্পধারা
  • বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
  • ইসলামী আন্দোলন
  • নাগরিক ঐক্য
  • জাতীয় পার্টি (এরশাদ)
  • জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন

আলোচনার জন্য আরও রয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বিএনপি, এবং বাম গণতান্ত্রিক জোটের অন্যান্য সদস্যরা।

কী বলছেন বিশ্লেষকরা?

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়ের প্রয়োজনে এই সংস্কার প্রক্রিয়া ইতিবাচক। তবে তাদের শঙ্কা, সময় যত কমে আসবে, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে মতবিরোধ তত বাড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. নুসরাত রুহী বলেন, “যদি সত্যিই এই কমিশন একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে চায়, তাহলে চূড়ান্ত রূপরেখায় সব রাজনৈতিক দলের সম্মতি নিশ্চিত করা জরুরি। কারণ, গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে হলে কেবল প্রস্তাব নয়, বাস্তব প্রয়োগও প্রয়োজন।”

চূড়ান্ত সময়ের চ্যালেঞ্জ

আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে হাতে আছে মাত্র আট মাসেরও কম সময়। এই সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক রদবদল এবং সর্বোপরি জনগণের আস্থা ফেরানো একটি জটিল ও সংবেদনশীল কাজ

প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসের কথায়, সময় আর বিলাসিতা নয়—এখনই প্রয়োজন সিদ্ধান্ত ও উদ্যোগের। সংশ্লিষ্টরা যদি এখন একযোগে কাজ করে, তবে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন সম্ভব

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button