অর্থনীতি

খেলাপি ঋণ বেড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা

দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা, যা গত সেপ্টেম্বর শেষে ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা।

আজ বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। রাজধানীর মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “খেলাপি ঋণ আরও বাড়তে পারে, তবে এটি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নীতিগত পরিবর্তন আনা হচ্ছে।”

খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—

১. অনিয়ন্ত্রিত ঋণ বিতরণ: রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে ব্যাংকগুলো নানা অনিয়মের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ প্রদান করেছে। 2. প্রভাবশালী গোষ্ঠীর ঋণখেলাপি হওয়া: বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা বড় অঙ্কের ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে। 3. নিয়ন্ত্রক সংস্থার দুর্বল ভূমিকা: কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয় ঋণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর না হওয়ার কারণে পরিস্থিতি আরও অবনতির দিকে যাচ্ছে। 4. কৃত্রিমভাবে খেলাপি ঋণ কম দেখানোর কৌশল: আগের সরকার বিভিন্ন সময় বিশেষ ছাড় ও পুনঃতফসিল সুবিধা দিয়ে খেলাপি ঋণ লুকানোর চেষ্টা করেছিল, যা এখন প্রকৃত চিত্র ফুটিয়ে তুলছে।

ব্যাংকিং খাতের সামগ্রিক পরিস্থিতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিসেম্বর ২০২৪ শেষে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে মোট ঋণ ও অগ্রিমের পরিমাণ ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের হার ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে এটি ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।

বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ তুলনামূলকভাবে বেশি বেড়েছে। এছাড়া এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপসহ বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণখেলাপির কারণে সামগ্রিক খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে।

খেলাপি ঋণের অর্থনীতির ওপর প্রভাব

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়ার ফলে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি হুমকির মুখে পড়তে পারে। এর প্রভাব হতে পারে—

  • ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট বৃদ্ধি: খেলাপি ঋণ বাড়লে ব্যাংকের হাতে ঋণ বিতরণের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে না। ফলে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে।
  • অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নষ্ট হওয়া: ব্যাংকগুলোর ক্ষতি সামলাতে সরকারকে প্রণোদনা দিতে হতে পারে, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য নেতিবাচক।
  • বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাওয়া: আর্থিক খাতের অব্যবস্থাপনা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করতে পারে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিকল্পনা ও ভবিষ্যৎ করণীয়

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর আশ্বস্ত করেছেন যে, ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের টাকা পাওয়ার কোনো সমস্যা হবে না। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছে বা নিতে যাচ্ছে—

  1. ঋণ পুনঃতফসিল কঠোর করা: আগের তুলনায় পুনঃতফসিলের সুযোগ সীমিত করা হবে।
  2. খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা: বড় ঋণখেলাপিদের আইনের আওতায় আনার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
  3. প্রকৃত খেলাপির তালিকা প্রকাশ: রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে প্রকৃত খেলাপিদের তথ্য প্রকাশ করা হবে।

বিশেষজ্ঞদের সুপারিশ

অর্থনীতি ও ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে আরও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। তাদের প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • স্বচ্ছ ও কঠোর ঋণ নীতি প্রণয়ন
  • খেলাপিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা
  • প্রভাবশালী ঋণখেলাপিদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সুবিধা বন্ধ করা
  • ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা

উপসংহার

খেলাপি ঋণের বর্তমান পরিস্থিতি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি শুধুমাত্র আর্থিক খাত নয়, পুরো অর্থনীতির জন্য হুমকির কারণ হতে পারে। সঠিক নীতি ও কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে, এটি আরও বড় সংকটে পরিণত হতে পারে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে, তবে এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button