দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে নিকুঞ্জ-১ এলাকায় সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধনের নামে রাষ্ট্রের প্রায় ২৪ কোটি টাকা ক্ষতিসাধন এবং অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করেছে। রোববার (৭ ডিসেম্বর) বিকেলে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে এক নিয়মিত মিডিয়া ব্রিফিংয়ে সংস্থাটির মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন এই চাঞ্চল্যকর তথ্য নিশ্চিত করেন। অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে তা আমলে নিয়ে গত ১৮ নভেম্বর এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এই অনুসন্ধানের মাধ্যমে দুদক আবারও প্রমাণ করল যে, ব্যক্তির পরিচয় দেখে নয়, বরং অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করেই দুর্নীতি দমন করা হবে।
বিস্তারিত: নিকুঞ্জের বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স ও সাজসজ্জা
দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেন। অভিযোগগুলো মূলত রাষ্ট্রের অর্থ অপচয় এবং ব্যক্তিগত অবৈধ সম্পদ অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত।
রাজধানীর অভিজাত নিকুঞ্জ এলাকার লেক ড্রাইভ রোডের ৬ নম্বর প্লটে তিনতলা বিশিষ্ট ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে আবদুল হামিদের। তিনি রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব শেষে ২০২৩ সালের এপ্রিলে সপরিবারে ওই বাড়িতে ওঠেন। অভিযোগ উঠেছে, ওই বাড়ির দু’পাশের রাস্তায় হাঁটার জন্য বাঁধা তৈরি, নান্দনিক ডেক ও ঝুলন্ত ব্রিজ নির্মাণ এবং খালসংলগ্ন অত্যাধুনিক ল্যাম্পপোস্ট স্থাপনের মাধ্যমে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২৪ কোটি টাকা।
অবৈধ সম্পদ: রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের পাশাপাশি তাঁর বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনেরও অভিযোগ আনা হয়েছে।
দুদক জানিয়েছে, অভিযোগ যাচাই-বাছাই শেষে তা আমলে নিয়ে গত ১৮ নভেম্বর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
দুদকের অবস্থান: ব্যক্তির পরিচয় নয়, বস্তনিষ্ঠতা মুখ্য
দুদকের মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এই অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় ব্যক্তির পদ বা পরিচয় কোনোভাবেই প্রভাব ফেলবে না।
পরিচয় দেখে নয়: তিনি বলেন, “দুদক কখনো ব্যক্তির পরিচয় দেখে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্ত করে না।”
অনুসন্ধানের ভিত্তি: তিনি বলেন, এখানে দেখার বিষয় হলো- অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতা এবং তা দুদকের তফসিলভুক্ত কিনা। সব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে যেকোনো দুর্নীতির বিরুদ্ধে যাচাই-বাছাই শেষে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিতে পারে কমিশন।
দুদকের এই কঠোর অবস্থান দেশের জনগণের মধ্যে দুর্নীতি দমনের বিষয়ে একটি ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতির মতো উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, বর্তমানে দেশে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
সাবেক রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা ও সুবিধা
বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদ আইন অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু এই অনুসন্ধানের আওতায় তাঁর বাড়ির আশপাশের এলাকায় যে সাজসজ্জা ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছে, তা ব্যক্তিগত বিলাসের জন্য করা হয়েছিল কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
সাধারণত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, বিলাসবহুল ডেক, ঝুলন্ত ব্রিজ এবং অত্যাধুনিক ল্যাম্পপোস্ট নির্মাণে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করা অর্থ অপচয়ের পর্যায়ে পড়ে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুদকের অনুসন্ধান এই ব্যয়ের যৌক্তিকতা খতিয়ে দেখবে।
এরশাদের বিরুদ্ধে দুদকের ব্যবস্থা
বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক রাষ্ট্রপতিকে দুদকের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। মহাপরিচালক আক্তার হোসেন এই বিষয়ে একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনেছেন:
“এর আগে, বাংলাদেশের ইতিহাসে দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকেও দুদকের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। পরে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সাজাও ভোগ করতে হয়েছিল তাকে।”
এই উদাহরণটি ইঙ্গিত দেয় যে, সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে আবদুল হামিদও যদি দোষী প্রমাণিত হন, তবে তাঁকে আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রমাণ করে যে, দুদকের তফসিলভুক্ত অভিযোগ থাকলে কোনো পদাধিকারীই আইনের ঊর্ধ্বে নন।
আইনি ও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে দুদকের এই অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত দেশের রাজনীতিতে এক নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
আইনের শাসন: বিশ্লেষকরা বলছেন, এই অনুসন্ধান প্রমাণ করে যে, দেশের রাজনীতিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রচেষ্টা চলছে।
রাজনৈতিক প্রভাব: সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রায় এক দশক ধরে দেশের সর্বোচ্চ পদে ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিরপেক্ষতা এবং দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকারকে তুলে ধরেছে।
এই অনুসন্ধানের ফলে সাবেক রাষ্ট্রপতির রাজনৈতিক জীবনের শেষ দিকে এসে তাঁর ভাবমূর্তির ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে।
উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদকের অঙ্গীকার
সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে নিকুঞ্জ এলাকায় সাজসজ্জার নামে রাষ্ট্রের ২৪ কোটি টাকা ক্ষতিসাধন ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের অনুসন্ধান শুরু করার সিদ্ধান্ত উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি দমনে কমিশনের অঙ্গীকারের একটি শক্তিশালী বার্তা। দুদকের মহাপরিচালকের মন্তব্য—ব্যক্তির পরিচয় নয়, অভিযোগের বস্তুনিষ্ঠতাই মুখ্য—দেশের দুর্নীতি দমন প্রক্রিয়ায় একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই অনুসন্ধানের ফলাফল দেশের রাজনীতি এবং আইনের শাসনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।
এম আর এম – ২৫২৯, Signalbd.com



