ঠাকুরগাঁও সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশের সাধারণ নাগরিকদের উপর অনিয়মিতভাবে গুলি চালানোর ঘটনা একটি দীর্ঘদিনের উদ্বেগজনক সমস্যা। স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক নীতিমালা অমান্য করে বিএসএফ সীমান্তে আগত বাংলাদেশিদের হত্যা করছে।
সীমান্ত আইন অনুযায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া সীমান্ত অতিক্রমকারী বা অনুপ্রবেশকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো নিষিদ্ধ। তবু বাস্তবতা ভিন্ন। ঠাকুরগাঁওয়ের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় গত এক দশকে কমপক্ষে ২৪ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন।
বিএসএফ এবং সীমান্ত হত্যা: বাস্তবতা ও অভিযোগ
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) জানিয়েছে, সীমান্ত অতিক্রম না করলে নিহত হওয়ার ঝুঁকি অনেক কম। তারা নিয়মিত সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং প্রতি পতাকা বৈঠকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের সতর্ক করছে যেন তারা নিরীহ মানুষদের লক্ষ্য করে গুলি না চালায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সীমান্তে বিনা কারণে তাড়া করা, ভয় দেখানো এবং গুলি চালানোর ঘটনা বারবার ঘটছে। শুধু সীমান্ত অতিক্রম নয়, জমিতে ঘাস কাটতে যাওয়া, মাছ ধরতে যাওয়া বা কৃষিকাজ করাও ঝুঁকিপূর্ণ।
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধীকারে হরিপুর, রাণীশংকৈল, বালিয়াডাঙ্গী ও আংশিক পীরগঞ্জ উপজেলায় বিস্তীর্ণ সীমান্তে ১৯টি বিজিবি আউটপোস্ট (বিওপি) রয়েছে। এর মধ্যে ১৬টি ঠাকুরগাঁওয়ে এবং ৩টি পঞ্চগড়ে। বহু সীমান্তে—যেমন বেউরঝাড়ী, কান্তিভিটা, রত্ননাই, বজরুক, মুন্ডুমালা, জগদল, চাপসার, নাগরভিটা, কান্দালে—বারবার গুলি এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
হতাহতের বাস্তব গল্প
২০১৯ থেকে ২০২৫ সালের মধ্যে সীমান্তে নিহতরা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রাণ হারিয়েছেন। কেউ আত্মীয়ের বাড়ি যাচ্ছিল, কেউ ঘাস কাটছিল, কেউ মাছ ধরছিল। আবার কেউ সরলভাবে সীমান্তে ঘুরতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে। নিহতদের অনেক সময় ‘চোরাকারবারী’ বলে আখ্যা দিয়ে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে বিএসএফ। তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, বাস্তবতা সবসময় ভিন্ন।
হরিপুরের রাসেল হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ দিই: তার মা সেলিনা বেগম বলেন, “মোর ছুয়াডা একটু বোকা ছিল। মানুষ কী বুঝাইছে আর কীভেবে গেছে বুঝি না। কিন্তু তাই বলে গুলি করে মারবে! ২০২৫ সালের জুলাইয়ে দিনাজপুর ৪২ বিজিবির আওতায় চাপসার সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হয় রাসেল।”
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে রাণীশংকৈলের ধর্মগড় সীমান্তে ১৫ বছর বয়সী কিশোর জয়ন্ত নিহত হন। তার বাবা মহাদেব মরদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। মুন্ডুমালা সীমান্তে শাহ আলমের একমাত্র ছেলে নিহত হলে তার মা-বাবা এখন অসহায়। বেউরঝাড়ীর নুরুজ্জামানের স্ত্রী আলেফা বেগম বলেন, “স্বামী ছাড়া সংসার চলে না। দুই ছেলেকে নিয়ে কি করি। বিজিবি তাকে চোরাকারবারী ট্যাগ দিলেও আমরা তা মানতে নারাজ।”
সীমান্ত হত্যা ও মানবিক দিক
এতগুলো পরিবারের জীবনে স্থায়ী দুঃখ ও অন্ধকার নেমে এসেছে। পিতৃহারা সন্তান, স্বামীহারা স্ত্রী, সন্তানহারা মা-বাবার জীবন কঠিন হয়ে গেছে। কেউ নিঃস্ব, কেউ দিশেহারা, কেউ চিকিৎসা খরচও জোগাতে পারছে না।
সাংস্কৃতিক কর্মী মাসুদ আহম্মেদ সূবর্ণ মনে করেন, দুর্বল পররাষ্ট্রনীতির কারণে সীমান্ত হত্যা বন্ধ হচ্ছে না। সরকারের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতের প্রতি নতজানু নীতি দেখা যায়। তিনি বলেন, “বাংলাদেশকে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। সীমান্ত হত্যার ঘটনার মোকাবিলা করতে আন্তর্জাতিক চাপও প্রয়োজন।”
তেল গ্যাস রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব মাহাবুব আলম রুবেল বলেন, “ফেলানীর মতো ন্যায়বিচারবঞ্চিত অসংখ্য পরিবার রয়েছে। এসব মামলা আন্তর্জাতিক আদালতে নেওয়া উচিত। ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার তাদের আছে।”
আইনি সহায়তা ও ন্যায়ের সম্ভাবনা
ঠাকুরগাঁও লিগ্যাল এইড অফিসার (সিনিয়র সহকারী জজ) মজনু মিয়া সীমান্তে হত্যাকাণ্ড নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, “সীমান্তে নিহতদের পরিবার এখনো ন্যায়ের জন্য লিগ্যাল এইড অফিসে আসেননি। দেশের প্রতিটি নাগরিকই সংবিধান অনুযায়ী বিচার পাওয়ার অধিকার রাখে। আমরা বিনা খরচে আইনি সহায়তা প্রদান করতে প্রস্তুত।”
বিজিবির দৃষ্টিকোণ
ঠাকুরগাঁও ৫০ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানজীর আহম্মদ বলেছেন, সীমান্তে প্রাণহানির সবচেয়ে বড় কারণ হলো সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা। মানুষ সীমান্ত না পেরোলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু ঘটার সুযোগই থাকে না।
তিনি আরও বলেন, “আমরা শুরু থেকেই চোরাকারবারি, নিয়ম অমান্যকারী বা সীমান্ত-সংলগ্ন পরিবারগুলোকে সচেতন করার চেষ্টা করি। গ্রাম পর্যায়ে ইমাম, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যুক্ত করা হয়েছে। তারা গ্রামের মানুষের কাছে বারবার বিষয়গুলো পৌঁছে দিচ্ছেন।”
রংপুর রিজিয়নের অধীনে ৪টি সেক্টর ও ১৫টি ব্যাটালিয়ন প্রায় ১,৬৬০ কিলোমিটার সীমান্তের দায়িত্বে। ঠাকুরগাঁও সীমান্তের দৈর্ঘ্য ১০৬.৪ কিলোমিটার। এখানে মানবপাচার রোধ, মাদকবিরোধী অভিযান, সীমান্ত হত্যা কমানোসহ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যুগপৎ কার্যক্রম চলছে।
তিনি বলেন, “মানুষ সচেতন হলে, আইন মেনে চললে, সহযোগিতা করলে সীমান্ত আরও শান্ত হবে। শান্ত সীমান্তই দুই দেশের মানুষের নিরাপত্তা ও সৌহার্দ্যের ভিত্তি।”
স্থানীয় সমাধানের প্রস্তাব
স্থানীয় মানিক নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা চাই সীমান্তে কাটাতাঁরের বেড়া হোক। তাহলে বিএসএফ আর আমাদের চোরাকারবারী বলে দোষ চাপাতে পারবে না।”
সীমান্ত হত্যা ও মানবিক অধিকার রক্ষার জন্য স্থানীয় জনগণ ও সরকারের যুগপৎ উদ্যোগ অপরিহার্য। সচেতনতা, আইনি সহায়তা এবং আন্তর্জাতিক নজরদারি সবই গুরুত্বপূর্ণ।
ঠাকুরগাঁও সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হওয়া ২৪ বাংলাদেশি শুধু সংখ্যা নয়; এ ঘটনা প্রতিটি পরিবারে দুঃখ, নিঃস্বতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের এক বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলে। স্থানীয় জনগণ, বিজিবি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা মিলিতভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। তবে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি ও আন্তর্জাতিক আইনি সহযোগিতা ছাড়া সীমান্তে ঘটে যাওয়া হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা সম্ভব নয়।
এই দীর্ঘ প্রতিবেদনটি সীমান্ত হত্যা, আইনি সহায়তা, মানবাধিকার এবং স্থানীয় সচেতনতার দিকগুলোকে আলোচনায় নিয়ে এসেছে, যা সীমান্ত নিরাপত্তা ও মানবিক প্রতিকার বিষয়ে পাঠকের পূর্ণ ধারণা দিতে সক্ষম।
MAH – 14166 I Signalbd.com



