রাজধানী ঢাকার আগারগাঁও এলাকায় ভোর রাতে গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। একটি বাসার ভেতরে হঠাৎ সৃষ্ট এই বিস্ফোরণে একই পরিবারের নারী–শিশুসহ ছয়জন মারাত্মকভাবে দগ্ধ হয়েছেন। আহতদের আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢামেক (ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছে।
শনিবার (৬ ডিসেম্বর) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে আগারগাঁও পাকা মার্কেট সংলগ্ন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বাম পাশে অবস্থিত একটি আবাসিক ভবনের কক্ষে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
দগ্ধরা হলেন—
- মো. জলিল মিয়া (৫০)
- আনেজা বেগম (৪০)
- আসিফ মিয়া (১৯)
- সাকিব মিয়া (১৬)
- মনিরা (১৭)
- ইভা (৬)
সকাল পৌনে ৮টার দিকে তাদের ঢামেকে আনা হয়।
★ কীভাবে ঘটল দুর্ঘটনা: মেয়ে জামাই আফরান মিয়ার বর্ণনা
দগ্ধদের ঢামেকে নিয়ে আসা মেয়ে জামাই আফরান মিয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন—
“আমার শ্বশুর জলিল মিয়া পরিবার নিয়ে ওই বাসায় থাকেন। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ একটা তীব্র শব্দ হয়। আমরা ফোন পেয়ে ছুটে আসি। ঘরে ঢুকতেই দেখি সবাই দগ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে। ঘরজুড়ে পোড়া গন্ধ আর ভাঙা কাঁচের ছড়াছড়ি। মনে হচ্ছিল আগুন মুহূর্তেই দাউ দাউ করে উঠেছিল। পরে দ্রুত তাদের ঢামেকে নিয়ে আসি।”
তিনি আরও জানান, হঠাৎ বিস্ফোরণের আগে বাসায় কোনো শব্দ বা গন্ধ টের পাওয়া যায়নি বলে ধারণা করা হচ্ছে। সবাই ঘুমিয়ে থাকায় গ্যাস জমে থাকার বিষয়টি তারা বুঝতে পারেননি।
★ ঢামেক বার্ন ইউনিটের বর্তমান অবস্থা
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্প ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক জানান—
“সকালে ছয়জনকে দগ্ধ অবস্থায় আনা হয়েছে। সবার ড্রেসিং চলছে, তাই এখনই সঠিকভাবে দগ্ধের শতাংশ বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি আমরা সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জানিয়েছি।”
বার্ন ইউনিটের এক চিকিৎসক জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে দগ্ধদের কয়েকজনের শরীরের ৩০ থেকে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়েছে। বিশেষ করে শিশু ও নারীর অবস্থা কিছুটা গুরুতর।
গ্যাস লিকেজ কেন হয়? বিশেষজ্ঞরা যেসব কারণ তুলে ধরছেন
ঢাকায় গ্যাস বিস্ফোরণের ঘটনা নতুন নয়। গত এক দশকে রাজধানীতে বিভিন্ন সময় গ্যাস জমে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে—মুগদা, মোহাম্মদপুর, শেখেরটেক, সিদ্দিকবাজার, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ আরও অনেক জায়গায় ঘটেছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
গ্যাস লিকেজের সাধারণ কারণসমূহ:
- পুরোনো বা নষ্ট গ্যাস লাইন
- চুলা বা গ্যাস রেগুলেটরের লিকেজ
- রান্নাঘরের বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে যাওয়া
- গ্যাসের গন্ধ বুঝেও সতর্কতার অভাব
- গ্যাস লাইনের বেআইনি সংযোগ বা অতিরিক্ত চাপ
- রাতে গ্যাস বন্ধ না করে রাখা
- বৈদ্যুতিক সুইচ অন–অফের সময় স্পার্ক সৃষ্টি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি রুমে যদি মাত্র ৫–৮ মিনিট গ্যাস জমা হয় এবং কেউ সুইচ অন করেন বা আগুন ধরান, সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ হতে পারে।
বাংলাদেশে গ্যাস বিস্ফোরণ দুর্ঘটনা: সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপট
গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ১৫০–২০০টি গ্যাস বা বয়লার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশের কারণ—
- গ্যাস লিকেজ
- পুরোনো লাইন
- অবহেলা
- বদ্ধ ঘর
২০২৩–২০২৫ সালের বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে প্রতিদিনই একাধিক বাড়ি বা প্রতিষ্ঠানে গ্যাস লিকেজের অভিযোগ আসে। তিতাস গ্যাসের তথ্যমতে, গ্যাসের ব্যবহার বাড়তে থাকলেও মানুষ নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট সচেতন নয়।
আগারগাঁও এলাকার বাসিন্দাদের আতঙ্ক
ঘটনার পর আগারগাঁওয়ের পাকা মার্কেট ও আশপাশের এলাকাবাসীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। স্থানীয়দের একজন বলেন—
“রাতে হঠাৎ এমন বিস্ফোরণের শব্দ শুনে মনে হলো ভূমিকম্প হলো। পরে জানতে পারলাম পাশের বাসায় বিস্ফোরণ ঘটেছে।”
অনেকে অভিযোগ করেন, এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে গ্যাসের চাপ কখনো বেশি, কখনো কম থাকে। কিছু বাসায় লিকেজও দেখা গিয়েছে।
দমকল বাহিনীর সতর্ক বার্তা
আগের দুর্ঘটনাগুলোর পর ফায়ার সার্ভিস বারবার সতর্ক করে আসছে—
যে পরিস্থিতিতে অবশ্যই সতর্ক হবেন:
- ঘরে ঢুকেই গ্যাসের গন্ধ পেলে কোনোভাবেই সুইচ অন/অফ করবেন না
- গ্যাসের লাইন বা চুলায় ফোঁটা পড়া শব্দ শোনা গেলে দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানাবেন
- রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে গ্যাসের চুলা ও রেগুলেটর অবশ্যই বন্ধ করবেন
- গ্যাসের চুলা নষ্ট হলে টেপ লাগানো বা নিজে মেরামতের চেষ্টা করা বিপজ্জনক
এছাড়াও, বাসায় এক্সস্ট ফ্যান বা বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখা বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশ বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকদের মত
বার্ন ইউনিটের চিকিৎসকরা বলেন—
- বদ্ধ ঘরে গ্যাস জমলে বিস্ফোরণ হলে সাধারণত শরীরের বড় অংশ দগ্ধ হয়
- পোড়া রোগীদের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি
- সংক্রমণ সবচেয়ে বড় ঝুঁকি
- শিশু ও প্রবীণদের ক্ষেত্রে শঙ্কা আরও বেশি
চিকিৎসকদের ভাষায়—
“প্রাথমিক ৭২ ঘণ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় শরীরের ফ্লুইড ব্যালান্স ঠিক রাখতে হয়। এরপর আসে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ।”
দুর্ঘটনার পরে তদন্ত কীভাবে এগোবে?
পুলিশ ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থল পরিদর্শনের প্রস্তুতি নিয়েছে। সাধারণত তদন্তে দেখা হয়—
- গ্যাস লাইনের কোথায় লিকেজ ছিল
- কোনো অনুমোদনহীন সংযোগ ছিল কি না
- ঘরটি বদ্ধ ছিল কি না
- বিস্ফোরণের উৎস—চুলা, সুইচ নাকি অন্য কিছু
আগের ঘটনার অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, লিকেজটি সাধারণত রান্নাঘর বা কক্ষের নীচের অংশে জমে থাকে। তাই যারা ঘুমিয়ে ছিলেন তারা বিষয়টি বুঝতে পারেননি।
কি কি প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা সবাইকে মানতেই হবে
Signalbd.com–এর পাঠকদের জন্য বিশেষজ্ঞদের দেওয়া জরুরি সতর্কতা নিচে তুলে ধরা হলো—
✔ ঘরে ঢুকে গ্যাসের গন্ধ পেলে কী করবেন?
- দরজা–জানালা খুলে দিন
- কোনো সুইচ–বোতাম স্পর্শ করবেন না
- চুলা বা রেগুলেটর পরীক্ষা করবেন না
- দ্রুত সবাইকে বাইরে বের হন
- জরুরি প্রয়োজনে ৯৯৯ বা ফায়ার সার্ভিসে ফোন দিন
✔ প্রতিদিনের নিয়ম:
- ঘুমোতে যাওয়ার আগে গ্যাস বন্ধ করা
- প্রতিমাসে গ্যাস লাইন পরীক্ষা
- রান্নাঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা রাখা
- নিয়মিত নতুন রাবার টিউব ব্যবহার করা
✔ যেসব কাজ একেবারেই করা যাবে না:
- নিজে নিজে গ্যাস পাইপ মেরামত
- চুলা নষ্ট হলে কাপড়/টেপ দিয়ে আটকে রাখা
- রাতে রান্নাঘরের জানালা বন্ধ রাখা
এ ধরনের দুর্ঘটনা কেন বাড়ছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরে—
- পুরোনো অবকাঠামো
- বাড়তি গ্যাস ব্যবহার
- নিরাপত্তা সচেতনতার অভাব
- ঘরের বদ্ধ পরিবেশ
- অপরিকল্পিত ফ্ল্যাট নির্মাণ
—এসব কারণে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
অনেক আবাসিকে যথাযথ বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা নেই। আবার অনেক ভবনে গ্যাসের লাইন ২০–৩০ বছর আগের, যা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের আওতায় আনা হয়নি।
সরকারি উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ করণীয়
দেশে গ্যাস পাইপলাইন আধুনিকায়ন এবং লিকেজ শনাক্তে ডিজিটাল সিস্টেম চালুর পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে—
- স্মার্ট গ্যাস মিটার
- লিকেজ মনিটরিং সেন্সর
- পুরোনো পাইপলাইন পরিবর্তন
- ব্যবহারকারীদের প্রশিক্ষণ
- বাড়ি–ভবনে নিরাপত্তা সনদ বাধ্যতামূলক করা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব ব্যবস্থা দ্রুত নেওয়া গেলে গ্যাস দুর্ঘটনা অনেক কমে আসবে।
সচেতনতা বাড়ালেই কমবে দুর্ঘটনা
আগারগাঁওয়ের এই দুর্ঘটনা আবারও মনে করিয়ে দিল—
গ্যাস লিকেজ একটি নীরব বিপদ।
এক মুহূর্তের অসতর্কতা মুহূর্তেই পুরো পরিবারকে বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
দগ্ধ ছয়জন এখনো চিকিৎসাধীন। তাদের দ্রুত সুস্থতার জন্য পরিবার–স্বজন ও স্থানীয়দের প্রার্থনা অব্যাহত রয়েছে।
Signalbd.com সময়োপযোগী আপডেট পাঠকদের জানিয়ে যাবে।
MAH – 14136 I Signalbd.com



