নাগরিক ঐক্যের সভাপতি এবং গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, দেশে নির্বাচন ছাড়া কোনো বিকল্প নেই এবং নির্বাচন অবশ্যই হতে হবে। তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, ‘এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছলচাতুরী করে আবার ক্ষমতায় বহাল থাকবেন, এই সুযোগ কমে গেছে।’ বৃহস্পতিবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম হলে গণতন্ত্র মঞ্চের উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন। এই মন্তব্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকাল এবং দেশে দ্রুত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে রাজনৈতিক মহলের প্রত্যাশাকে তুলে ধরেছে। সভায় গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা নির্বাচন, চলমান রাজনৈতিক সংকট এবং দেশের অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
নির্বাচন ছাড়া বিকল্প নেই: অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি বার্তা
মাহমুদুর রহমান মান্না তাঁর বক্তব্যে দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে নির্বাচনের গুরুত্বের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, দেশ আজ ১৫ বছর ধরে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হলে দ্রুততম সময়ে একটি নির্বাচন সম্পন্ন করা আবশ্যক।
তিনি বলেন, ‘যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, তারা তো নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করছে না।’ জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এনসিপিও নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে চায় না, বরং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তফসিল ঘোষণা করতে বলেছে। মান্না মনে করেন, ‘আগেভাগে ধরে নিচ্ছি নির্বাচন হবে এবং তার ভিত্তিতেই আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হবে।’ তাঁর এই বক্তব্য নির্বাচনমুখী রাজনীতির প্রতি গণতন্ত্র মঞ্চের অঙ্গীকারকে নির্দেশ করে।
শেখ হাসিনা ও ভারতের নিরপেক্ষ অবস্থান
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় এবং এই বিষয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া নিয়েও মাহমুদুর রহমান মান্না মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় হয়েছে, কিন্তু ভারত হুলস্থুল কিছু করতে পারেনি। ভারত নিরপেক্ষ বিবৃতি দিয়েছে।’
মান্নার মতে, আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি বিবেচনা করে ‘পরিস্থিতি মানা ছাড়া তাদের কোনো পথ নেই।’ এই মন্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, দেশের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং আইনি প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো মেনে নিয়েছে। ভারতের পক্ষ থেকে আসা এই নিরপেক্ষ অবস্থান বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাদের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের অভিযোগকে কিছুটা প্রশমিত করতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
খালেদা জিয়ার অসুস্থতা ও নির্বাচনের সময় নিয়ে প্রশ্ন
বেগম খালেদা জিয়ার গুরুতর অসুস্থতা এবং তাঁর জীবন সঙ্কটাপন্ন হয়ে ওঠার বিষয়টি নিয়েও মাহমুদুর রহমান মান্না উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘সময়টা কিন্তু ভালো না, বেশ জটিল। নির্বাচন কি হবেই?’
তিনি মন্তব্য করেন, ‘বেগম জিয়া অসাধারণ একজন ব্যক্তি। তার জন্য সবাই দোয়া করছে এবং আমরাও করছি।’ তবে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এ অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে বিএনপি নির্বাচন করতে পারবে? এর চাইতেও যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলেই কেবল নির্বাচনের সময় নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।’ এই বক্তব্য ইঙ্গিত দেয় যে, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার অবস্থা যদি আরও খারাপ হয় এবং তিনি স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে না পারেন, তবে বিএনপি এবং অন্যান্য দল নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার দাবি তুলতে পারে।
গণতন্ত্র মঞ্চের লক্ষ্য: পরিবর্তন না এলে নির্বাচন দিয়ে কী হবে?
বিএনপির রাজনৈতিক কৌশল এবং গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যেকার বোঝাপড়ার বিষয়েও মাহমুদুর রহমান মান্না মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘বিএনপি আমাদের সঙ্গে বসেনি। তারা নিজের মতো প্রার্থী ঘোষণা করেছে। সেটা নিয়ে অনেক ঝামেলা চলছে।’ তিনি মনে করেন, এই পরিস্থিতিতে কে কয়টা আসন পাবে, সেই কথা ভাবার আগে সবাইকে ভাবতে হবে ‘এই নির্বাচন সম্পর্কে আসলে জনগণ কী ভাবছে।’
গণতন্ত্র মঞ্চের লক্ষ্য কেবল নির্বাচন নয়, বরং দেশে প্রকৃত পরিবর্তন আনা। তিনি বলেন, ‘দেশে যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে নির্বাচন দিয়ে কী হবে। গণতন্ত্র মঞ্চ সেই নির্বাচনের কথা বলে না।’ গণতন্ত্র মঞ্চ সেই নির্বাচনের কথা বলে, যা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করবে এবং জনগণের ক্ষমতা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সাংগঠনিক প্রস্তুতি
আলোচনা সভায় বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক গণতন্ত্র মঞ্চের সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পর্কে তথ্য দেন। তিনি বলেন, গণতন্ত্র মঞ্চ নির্বাচনের প্রস্তুতি অব্যাহত রেখেছে। ‘আমরা ইতোমধ্যে ১৩৮ জনের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছি। আশা করছি, অল্পদিনের মধ্যে ৩০০ আসনে গণতন্ত্র মঞ্চ তার স্বাধীন জায়গা থেকে আমরা প্রার্থিতা ঘোষণা করতে পারবে।’
সাইফুল হক আরও বলেন, তাঁরা নিয়মিত গণসংযোগের কাজ অব্যাহত রেখেছেন। একইসঙ্গে, তিনি ইঙ্গিত দেন, ‘পাশাপাশি আমরা বিএনপির সঙ্গেও একটা রাজনৈতিক বোঝাপড়া তৈরি করতে চাই।’ তিনি অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কথা বললেও, সেই সরকারের প্রতি আস্থা অর্জনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।
নির্বাচন ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সম্পর্ক
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি তাঁর বক্তব্যে নির্বাচন এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যেকার সম্পর্কের ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, ‘সংস্কার এবং নির্বাচন এখন অঙ্গাঙ্গিকভাবে যুক্ত।’ তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, যদি কেউ নির্বাচনকে বানচালের তৎপরতা করে, তার মানে হলো তারা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণকে পিছিয়ে দিতে চায়। ‘এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধান জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে তারা দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।’
জোনায়েদ সাকি স্পষ্ট করেন, দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ঘুরে দাঁড়াতে হলে যে নতুন বিনিয়োগ এবং পরিস্থিতির দরকার, সেখানে নির্বাচন এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। তিনি বলেন, ‘অর্থাৎ আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সর্বোপরি আমাদের গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচন অপরিহার্য।’
নির্বাচনই সমাধান, কিন্তু শর্তসাপেক্ষে
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নার বক্তব্য দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং নির্বাচনের অপরিহার্যতাকে তুলে ধরে। অন্তর্বর্তী সরকারের ছলচাতুরী করে ক্ষমতায় থাকার সুযোগ কমে এসেছে বলে তিনি মনে করেন। তবে গণতন্ত্র মঞ্চ মনে করে, নির্বাচন হতে হবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণের এবং পরিবর্তনের লক্ষ্যে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতা নির্বাচনের সময় নিয়ে প্রশ্ন তুললেও, গণতন্ত্র মঞ্চ নির্বাচনমুখী এবং তারা বিশ্বাস করে, দেশের অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতার জন্য নির্বাচন অপরিহার্য।
এম আর এম – ২৫০৫, Signalbd.com



