আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অসুস্থতার এই সময়ে তফসিল ঘোষণার বিষয়ে নিজেদের স্পষ্ট অবস্থান জানিয়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘অনিবার্য কোনো কারণ ছাড়া নির্বাচন বিলম্ব হোক আমরা চাই না।’ তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, ‘আমরা ১৫ বছর থেকে নির্বাচন চাচ্ছি। জনগণের ভোটের অধিকার আমরা ফিরিয়ে দিতে চাই এবং যথাসময়ে নির্বাচন হবে, তা আমরা চাই।‘ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
যথাসময়ে নির্বাচনের প্রত্যাশা: ১৫ বছরের দাবি
বিএনপি নেতা নজরুল ইসলাম খান তাঁর বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে দলের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ভোটের অধিকার থেকে বঞ্চিত। এই অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই বিএনপি আন্দোলন করছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় আছি। অনিবার্য কোনো কারণ ছাড়া আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ার বাইরে যেতে চাই না।’ এই মন্তব্যটি বিএনপির পক্ষ থেকে একটি শক্তিশালী বার্তা যে, তারা নির্বাচন বর্জন না করে ঘোষিত সময়েই নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী, যদি সেখানে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত হয়। দলের পক্ষ থেকে এই অবস্থান সরকারের প্রতিও দ্রুত নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য একটি চাপ সৃষ্টি করে।
সংসদ ও গণভোট: ভোটাধিকার বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা
বিএনপি প্রতিনিধিদল এবার একসঙ্গে অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন ও গণভোট—এই দুই ভোটের প্রক্রিয়া নিয়ে নির্বাচন কমিশনের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। নজরুল ইসলাম খান বলেন, আগে শুধু সংসদ নির্বাচনের জন্য ভোট হতো এবং সেখানে ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা নির্ধারণ থাকত। কিন্তু এবার একসঙ্গে দুটো ভোটের ব্যালটে ভোট দিতে হবে, যার জন্য সময় বেশি লাগবে।
তিনি ইসির কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘যাতে কোনো ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়।’ একসঙ্গে দুই ধরনের ভোট হলে সময় বেশি লাগার কারণে ভোটারের দীর্ঘ লাইন এবং সময়ের অভাবে অনেকে ভোট দিতে না পারার আশঙ্কা থাকে। কমিশন এই উদ্বেগের বিষয়ে আগামী রোববার (৭ ডিসেম্বর) সিদ্ধান্ত নেবেন বলে নজরুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের জানান।
প্রবাসী ভোটার: পাসপোর্ট দিয়ে নিবন্ধনের প্রস্তাব
দেশের বাইরে থাকা বাংলাদেশি প্রবাসী ভোটারদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ বাড়ানোর জন্য নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব তুলে ধরেছে বিএনপি। নজরুল ইসলাম খান বলেন, প্রবাসীদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) পাশাপাশি পাসপোর্ট দিয়েও নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়ার প্রস্তাব তুলে ধরা হয়েছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাই আরও বেশি বেশি প্রবাসী ভোটার হোক।’ প্রবাসীরা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখলেও ভোটের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ সীমিত। পাসপোর্টকে নিবন্ধনের জন্য বিবেচনা করা হলে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হতে পারবেন এবং দেশের রাজনীতিতে তাঁদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।
ব্যালট পেপার: বেসরকারি প্রেসে মুদ্রণের বিরোধিতা
নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য ব্যালট পেপার মুদ্রণের বিষয়েও নির্বাচন কমিশনের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিএনপি প্রতিনিধিদল। নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘ব্যালট পেপার সরকারি প্রেস থেকে ছাপানো হয়। এবার আমরা শুনতে পেয়েছিলাম যে প্রাইভেট প্রেসে ছাপানো হতে পারে।’
এর পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি জোরালোভাবে বলেছে, ‘ব্যালট পেপার যাতে কোনো প্রাইভেট প্রেসে ছাপানো না হয়।’ বেসরকারি প্রেসে ব্যালট ছাপানো হলে সেখানে জালিয়াতি বা কারচুপির সুযোগ তৈরি হতে পারে বলে বিএনপি আশঙ্কা প্রকাশ করেছে। কমিশন বিএনপিকে আশ্বাস দিয়েছে যে, সরকারি প্রেস থেকেই ব্যালট ছাপানো হবে।
বৈঠকে উপস্থিত প্রতিনিধিদল ও পূর্বপটভূমি
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় নির্বাচন ভবনে সিইসি এ এম এম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠককালে বিএনপির প্রতিনিধিদলে নজরুল ইসলাম খান ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ এবং ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. মোহাম্মদ জকরিয়া। ইসির পক্ষে জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদও উপস্থিত ছিলেন।
এই বৈঠক এমন এক সময়ে হলো যখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার অসুস্থতা এবং দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। খালেদা জিয়ার অসুস্থতার কারণে দলীয় কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও, বিএনপি নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে সরে যাচ্ছে না, এই বার্তাই দিতে চেয়েছেন নজরুল ইসলাম খান।
নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পথে বিএনপির প্রত্যাশা
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের বক্তব্য দেশের রাজনীতিতে একটি সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: অনিবার্য কারণ ছাড়া নির্বাচন বিলম্বিত হোক, তা চায় না বিএনপি। দলের প্রধান লক্ষ্য হলো ঘোষিত সময়েই জনগণের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনা। সংসদ ও গণভোটের প্রক্রিয়া, প্রবাসী ভোটারদের নিবন্ধন এবং ব্যালট পেপারের নিরাপত্তা নিয়ে ইসির কাছে তাঁদের উদ্বেগগুলো মূলত একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দলের প্রত্যাশাকেই প্রতিফলিত করে। নির্বাচন কমিশন ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট সংক্রান্ত জটিলতা নিরসনে কী সিদ্ধান্ত নেয়, তার ওপরই নির্ভর করছে নির্বাচনের পথে পরবর্তী পদক্ষেপ।
এম আর এম – ২৫০০, Signalbd.com



