শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা দাবি আদায়ে শ্রেণিকক্ষের দরজায় তালা ঝুলিয়ে পরীক্ষাবর্জন করলে সেখানে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনীষা আহমেদ। বাইরে যখন বার্ষিক পরীক্ষার জন্য শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করছিল, তখন ইউএনও স্বয়ং শ্রীবরদী উপজেলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শ্রেণিকক্ষের তালা ভেঙে পরীক্ষার কার্যক্রম চালু করেন। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) সকাল ১১টার দিকে তিনি তালা খুলে পরীক্ষা শুরু করান। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জরুরি নির্দেশনা এবং শাস্তির সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে শিক্ষকরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাওয়ায় ইউএনও’র এই কঠোর পদক্ষেপটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সৃষ্ট অচলাবস্থাকে তুলে ধরল।
তালা ভাঙার ঘটনা ও ইউএনও’র তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ
শিক্ষকদের কর্মবিরতির কারণে শ্রীবরদী উপজেলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ ছিল। শিক্ষার্থীরা যথাসময়ে স্কুলে এলেও শ্রেণিকক্ষে তালা ঝুলে থাকায় তারা ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। এমন পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মনীষা আহমেদ খবর পেয়ে সকাল ১১টার দিকে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হন।
ইউএনও মনীষা আহমেদ বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা না নিয়ে আন্দোলন করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে উপজেলা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ তিনি সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নূরন নবীসহ অন্যান্যদের উপস্থিতিতে শ্রেণিকক্ষের তালা খুলে পরীক্ষা শুরু করান। একজন সরকারি কর্মকর্তার পক্ষ থেকে এভাবে সরাসরি তালা ভেঙে পরীক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া প্রমাণ করে যে, সরকার শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে কোনো প্রকার বাধা সৃষ্টি মেনে নিতে রাজি নয়।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কঠোর নির্দেশনা
শিক্ষকদের এই কর্মবিরতি ও পরীক্ষা বর্জনের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) একটি জরুরি নির্দেশনা জারি করেছিল। মন্ত্রণালয় শিক্ষকদের অবিলম্বে পরীক্ষায় ফিরতে নির্দেশ দেয়।
ইউএনও মনীষা আহমেদ সেই নির্দেশনা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জরুরি নির্দেশনা দিয়ে শিক্ষকদের অবিলম্বে পরীক্ষায় ফিরতে বলেছে।’ একইসাথে মন্ত্রণালয় শাস্তির সতর্কবার্তাও দিয়েছে: কর্মবিরতি চলমান থাকলে সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সরকারি চাকরি আইন, আচরণবিধি ও ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের এই কঠোর বার্তা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকদের একাংশের তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার প্রবণতা প্রমাণ করে যে, তাঁরা তাঁদের দাবি আদায়ে কঠোর অবস্থানে আছেন।
অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ও মানসিক চাপ
শিক্ষকদের এই কর্মবিরতি ও পরীক্ষাবর্জনে অভিভাবকরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অভিভাবক হালিম মিয়া বলেন, ‘যখন-তখন করে শিক্ষকরা পরীক্ষা বন্ধ করবে এটা কোনোভাবেই কাম্য নয়। বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ থাকলে শিশুরা মানসিক চাপে পড়ে। শিক্ষকরা মানুষ গড়ার কারিগর, তাদের উচিত আন্দোলন করলেও পরীক্ষা বন্ধ না করা।’
আরেক অভিভাবক ইসমাইল হোসেন শিক্ষকদের এই কর্মসূচিকে ‘শিক্ষার্থীদের জিম্মি করা’ বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বলব এটা আন্দোলন না, এটা শিক্ষার্থীদের জিম্মি করা। সরকারকে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজন হলে নতুন করে শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে। পরীক্ষা বর্জন করে আন্দোলন এটা কেমন আন্দোলন?’ এই ক্ষোভ প্রমাণ করে যে, শিক্ষার্থীরা এবং অভিভাবকরা পরীক্ষার বিষয়ে কোনো আপস করতে রাজি নন।
শিক্ষকদের দাবির যৌক্তিকতা ও চ্যালেঞ্জ
শিক্ষকদের দাবিগুলোর মধ্যে বেতন স্কেলের বৈষম্য এবং পদোন্নতির জটিলতা নিরসনের মতো বিষয়গুলো যৌক্তিক বলে বিবেচিত। তবে শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সি আর আবরার এই দাবিগুলোকে ‘অন্যায় ও অযৌক্তিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর মতে, নবম গ্রেডের দাবি বিসিএস ক্যাডারদের সঙ্গে সমতার প্রশ্ন তোলে, যা আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বিষয় এবং এককভাবে সমাধান করা সম্ভব নয়।
ইউএনও’র এই পদক্ষেপ এবং সরকারের কঠোর অবস্থান এখন শিক্ষকদের সামনে দুটি পথ খোলা রেখেছে— হয় কঠোর শাস্তির মুখোমুখি হওয়া, নতুবা শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই সমস্যার দীর্ঘমেয়াদী সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এই ধরনের অচলাবস্থা আরও বাড়তে পারে।
ইউএনও’র পদক্ষেপ ও শিক্ষার অধিকার
শেরপুরের শ্রীবরদীতে ইউএনও মনীষা আহমেদের বিদ্যালয়ের তালা ভেঙে বার্ষিক পরীক্ষা চালু করার পদক্ষেপটি দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার একটি জোরালো উদাহরণ। যখন শিক্ষকরা তাদের দাবি আদায়ের জন্য শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার কৌশল নেন, তখন প্রশাসনের এমন কঠোর হস্তক্ষেপ অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তবে এই ধরনের ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপের পরিবর্তে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে শিক্ষকদের সঙ্গে দ্রুত ফলপ্রসূ আলোচনায় বসে এবং তাদের ন্যায্য দাবিগুলোর সুরাহা করে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে।
এম আর এম – ২৪৯৪, Signalbd.com



