বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বারবার দেশপ্রেম ও আপসহীনতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘এই দেশ ছেড়ে, এই দেশের মানুষকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা।’ চট্টগ্রাম-২ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী সরওয়ার আলমগীর মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর) রাতে ফটিকছড়ির সুন্দরপুরে আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এই ঐতিহাসিক উক্তিটির কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তিনি বলেন, সামান্য সমঝোতা করলে আরাম-আয়েশে থাকতে পারতেন, কারাবরণ করতে হতো না, কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন সংগ্রামের পথ। বেগম খালেদা জিয়ার এই দৃঢ় অবস্থান দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক গভীর আবেগ ও অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে।
আপসহীন নেত্রীর দৃঢ় অঙ্গীকার ও অবস্থান
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর আপসহীন নেত্রী উপাধির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। তাঁর এই অবস্থান জীবনের বিভিন্ন কঠিন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে। তিনি বারবার জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁর জীবনের একমাত্র ঠিকানা এই দেশ এবং এখানকার মানুষ।
বিএনপি নেতা সরওয়ার আলমগীর জনসভায় বলেন, ‘খালেদা জিয়া বলেছিলেন, বিদেশে তাঁর কোনো প্রভু নেই, এ দেশের মাটি ও মানুষ তাঁর আপনজন।’ তিনি মনে করেন, সামান্য সমঝোতা করলে, যেমন রাজনীতি না করা বা দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে গেলে, বেগম খালেদা জিয়াকে হয়তো কারাগারে থাকতে হতো না এবং তাঁকে জুলুম নির্যাতনের শিকার হতে হতো না। কিন্তু তিনি ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশকে ত্যাগ করে সংগ্রামের পথকে বেছে নিয়েছিলেন। এই ত্যাগ তাঁর দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতির গভীরতা প্রমাণ করে।
সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবনের শুরুই হয়েছিল সংগ্রাম দিয়ে। ১৯৮১ সালের ৩০ মে সামরিক অভ্যুত্থানে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এবং তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর, নেতৃত্বহীন দলে পুনরুজ্জীবন ঘটাতে সামনে আসেন খালেদা জিয়া। তিনি কেবল দলকে সংগঠিত করেননি, সামরিক শাসক এরশাদের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন।
তাঁর এই দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামের ফলস্বরূপ ১৯৯০ সালে স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। পরের বছর, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। তাঁর পুরো রাজনৈতিক জীবনে তিনি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে কখনোই আপস করেননি এবং ভয় বা লোভের কাছে মাথা নত করেননি।
ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে আপসকে প্রত্যাখ্যান
ওয়ান-ইলেভেনের সময়কালে, অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের (মইনুদ্দিন–ফখরুদ্দিন) আমলে, বেগম খালেদা জিয়ার কাছে আপসের প্রস্তাব এসেছিল। এক সমাবেশে তিনি বলেছিলেন, ‘মইনুদ্দিন–ফখরুদ্দিন আমার সঙ্গে কথা বলেছে, আমাকে দেশের বাইরে পাঠানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে। আমি যেতে রাজি হইনি বলে আমার সন্তানদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, আপনারা দেখেছেন।’
তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল, আপনি না গেলে মামলা দেওয়া হবে, ছেলেদের ধরে নিয়ে যাওয়া হবে।’ জবাবে খালেদা জিয়া স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন,
‘আমি দেশ ছেড়ে, দেশের মানুষকে ছেড়ে কোথাও যাব না। এই দেশই আমার একমাত্র ঠিকানা। দেশের বাইরে আমার কিছু নেই, কোনো ঠিকানাও নেই।’
এই অনড় অবস্থান তাঁকে কারাবরণ করতে বাধ্য করে এবং তাঁর দুই ছেলের ওপরও নির্যাতন হয়, কিন্তু তিনি তাঁর জনগণকে ছেড়ে যাননি।
বিগত সরকারের সময়ে কারাবরণ ও প্রত্যাবর্তনের দৃঢ়তা
বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলেও বেগম খালেদা জিয়াকে পুনরায় কারাবরণ করতে হয়। রায় ঘোষণার কিছুদিন আগে চিকিৎসার জন্য তিনি লন্ডনে গিয়েছিলেন। তখন তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা দাবি করেছিল যে, তিনি আর দেশে ফিরবেন না। কিন্তু তিনি সেই সব জল্পনা উড়িয়ে দিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঝড় নামবে জেনেও এবং গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়ে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরে দীর্ঘ তিন বছর তাঁকে কারাগারে থাকতে হয়। জানা যায়, সে সময়ও তাঁকে নানা প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল—রাজনীতি না করলে বা দেশ ছেড়ে গেলে তাঁকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে না এমন ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আপসহীন নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কোনো অবস্থাতেই মাথা নত করেননি।
জনসভা ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতি
মঙ্গলবার রাতে ফটিকছড়ির সুন্দরপুরে আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম-২ আসনের বিএনপি মনোনীত প্রার্থী সরওয়ার আলমগীর। সুন্দরপুর ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি সুজা উদ্দিন চৌধুরী এই সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং আতিক চৌধুরী সভা সঞ্চালনা করেন।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন—ফটিকছড়ি পৌরসভা বিএনপির আহ্বায়ক মোবারক হোসেন কাঞ্চন, প্রবীণ বিএনপি নেতা আহমদ হোসেন তালুকদার, জেলা কৃষক দলের সদস্য সচিব নাজিম উদ্দীন শাহীন, মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল আলম চৌধুরী ও নাজিরহাট পৌরসভা বিএনপির সদস্য সচিব শাহসহ স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। এই জনসভা বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনা এবং তাঁর আদর্শের প্রতি সংহতি প্রকাশের একটি বড় মঞ্চ ছিল।
আপসহীন আদর্শের অনুপ্রেরণা
বেগম খালেদা জিয়ার ‘এ দেশ ছেড়ে, এ দেশের মানুষকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না’—এই ঘোষণা কেবল একটি বক্তব্য নয়, এটি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক আদর্শ এবং সংগ্রামের প্রতীকী রূপ। সামান্য আরাম-আয়েশের সুযোগ থাকলেও তিনি জনগণের পাশে থাকার জন্য কঠিন পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর এই আপসহীনতা তাঁর দলীয় নেতাকর্মী এবং দেশের সাধারণ মানুষের জন্য এক চিরন্তন অনুপ্রেরণা। সরওয়ার আলমগীরের জনসভায় তাঁর এই উক্তি স্মরণ করিয়ে দেওয়া প্রমাণ করে যে, অসুস্থতা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার আদর্শ এখনও দলের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি।
এম আর এম – ২৪৭৬, Signalbd.com



