বাংলাদেশ

আহত জুলাইযোদ্ধাদের জন্য নির্মাণ হচ্ছে ১৫৬০ ফ্ল্যাট, ব্যয় ১৩৪৪ কোটি টাকা

Advertisement

২০২৪ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত জুলাইযোদ্ধাদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মিরপুরে ১ হাজার ৫৬০টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ করা হবে। এই বৃহৎ প্রকল্পের জন্য মোট ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। সোমবার (১ ডিসেম্বর) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় এই সংক্রান্ত প্রকল্প পাস করা হয়। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য স্থায়ী সমাধানের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এছাড়াও, শহিদ পরিবারকে স্থায়ী বাসস্থান প্রদানের জন্য ৭৬১ কোটি টাকা ব্যয়ে আলাদা একটি প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়েছে।

ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের বিস্তারিত ও ব্যয়ভার

আহত জুলাইযোদ্ধাদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পটি জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়ন করবে। মিরপুর এলাকায় এই ফ্ল্যাটগুলো নির্মিত হবে। প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্যানুসারে:

  • মোট ফ্ল্যাট সংখ্যা: ১,৫৬০টি।
  • মোট প্রকল্প ব্যয়: ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা।
  • বাস্তবায়নকারী সংস্থা: জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ।
  • প্রকল্পের মেয়াদ: এ বছরের জুলাই মাস থেকে ২০২৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত।

এই ফ্ল্যাটগুলো নির্মাণের মাধ্যমে জুলাই অভ্যুত্থানে আহত এবং শারীরিক বা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ব্যক্তিদের স্থায়ী ও মানসম্মত বাসস্থান নিশ্চিত করা হবে। এই বিপুল ব্যয়ভার সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন, প্রকল্প ঋণ এবং সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নের মাধ্যমে মেটানো হবে। একনেক সভায় অনুমোদিত মোট ১৭টি প্রকল্পের মধ্যে এই দুটি আবাসন প্রকল্প অন্যতম প্রধান।

শহিদ পরিবারদের জন্য পৃথক আবাসন প্রকল্প

আহতদের জন্য ফ্ল্যাট প্রকল্পের পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানে শহিদ পরিবারকে স্থায়ী বাসস্থান প্রদানের জন্য সরকার একটি আলাদা প্রকল্পও অনুমোদন করেছে। এই মানবিক প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে ‘৩৬ জুলাই’ আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ

  • মোট খরচ: ৭৬১ কোটি টাকা।
  • বাস্তবায়ন: জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের নিজস্ব জমিতে এই ফ্ল্যাটগুলো নির্মিত হবে।
  • সমাপ্তির লক্ষ্য: ২০২৮ সাল।

শহিদ পরিবারদের প্রতি রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতা এবং দায়িত্ববোধের অংশ হিসেবে এই প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এই ফ্ল্যাটগুলো শহিদ পরিবারগুলোকে সম্মানজনক ও স্থায়ী আবাসন নিশ্চিত করবে। এই দুটি প্রকল্প একসাথে পাস করায় জুলাই অভ্যুত্থানের ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সরকারের অঙ্গীকার আরও জোরালো হলো।

একনেক সভায় অনুমোদিত প্রকল্প ও অর্থায়ন

প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে একনেক সভায় মোট ১৫ হাজার ৩৮৩ কোটি ৫১ লাখ টাকা ব্যয় সম্বলিত ১৭টি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। এই বিশাল ব্যয়ভারের অর্থায়নের উৎসগুলো হলো:

  • সরকারের নিজস্ব অর্থায়ন (জিওবি): ৯ হাজার ৪৫১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা (মোট ব্যয়ের সিংহভাগ)।
  • প্রকল্প ঋণ (পিএল): ৫ হাজার ৬০৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
  • সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন: ৩৭৯ কোটি ৩১ লাখ টাকা।

এই পরিসংখ্যান সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের গতিশীলতা এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগের অগ্রাধিকার তুলে ধরে। গৃহীত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবহন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাত।

একনেক সভায় উপস্থিত উপদেষ্টামণ্ডলী

প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই গুরুত্বপূর্ণ একনেক সভায় সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের প্রায় সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন:

  • পরিকল্পনা উপদেষ্টা: ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ
  • পররাষ্ট্র উপদেষ্টা: মো. তৌহিদ হোসেন
  • খাদ্য এবং ভূমি উপদেষ্টা: আলী ইমাম মজুমদার
  • সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক উপদেষ্টা: শারমীন এস মুরশিদ
  • স্বরাষ্ট্র এবং কৃষি উপদেষ্টা: লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)
  • শিল্প এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা: আদিলুর রহমান খান
  • বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ, সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেলপথ উপদেষ্টা: মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান
  • পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ উপদেষ্টা: সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান
  • স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ উপদেষ্টা: নূরজাহান বেগম
  • শিক্ষা উপদেষ্টা: অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার

এছাড়াও সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। উপদেষ্টা পরিষদের এই সম্মিলিত উপস্থিতি সরকারের নীতি নির্ধারণী প্রক্রিয়ার সমন্বিত প্রচেষ্টাকে নির্দেশ করে।

পুনর্বাসনের গুরুত্ব ও মানবিক দিক

জুলাই অভ্যুত্থানে আহত ও শহিদ পরিবারদের জন্য এই আবাসন প্রকল্পগুলোর অনুমোদন মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অভ্যুত্থান দেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক। আহতদের চিকিৎসা সহায়তা এবং শহিদ পরিবারের জন্য আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পাশাপাশি স্থায়ী বাসস্থান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব

জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হওয়ায় এটি নিশ্চিত হবে যে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য নির্মিত ফ্ল্যাটগুলো মানসম্মত এবং স্থায়ী হবে। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে সরকার কেবল ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনই করছে না, বরং গণতন্ত্রের জন্য ত্যাগ স্বীকারকারী মানুষের প্রতি রাষ্ট্রের কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করছে।

মতামত: দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই আবাসন প্রকল্পগুলো সামাজিক উন্নয়ন এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে সরকারের একটি বড় বিনিয়োগ। যদিও প্রকল্প ব্যয় বিপুল, তবুও এই বিনিয়োগের সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্য অনেক বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই প্রকল্পগুলো সময়মতো এবং স্বচ্ছতার সঙ্গে বাস্তবায়ন করা জরুরি, যাতে ক্ষতিগ্রস্তরা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তাদের ফ্ল্যাট বুঝে নিতে পারে। এই ধরনের বৃহৎ প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়ন সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে এবং ভবিষ্যতে জাতীয় উন্নয়নে সহায়ক হবে। ২০২৯ সালের মধ্যে আহতদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ সম্পন্ন করার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে।

অঙ্গীকার পূরণ ও নতুন বাংলাদেশের সূচনা

আহত জুলাইযোদ্ধা ও শহিদ পরিবারদের জন্য আবাসন প্রকল্প অনুমোদন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ১ হাজার ৫৬০টি ফ্ল্যাট এবং ৩৬ জুলাই আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণে মোট প্রায় ২ হাজার ১০৫ কোটি টাকারও বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে, যা গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামকারীদের প্রতি রাষ্ট্রের গভীর অঙ্গীকারের প্রতীক। এই প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়ন শুধু ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জীবনযাত্রার মান উন্নয়নই করবে না, বরং নতুন বাংলাদেশে ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

এম আর এম – ২৪৫১,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button