বাংলাদেশ

দেশজুড়ে ভবন ও নির্মাণ কাজ অনুমোদনে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ

Advertisement

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের সকল ভবন ও নির্মাণ কাজের অনুমোদনের জন্য একটি পৃথক এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিরাপদ নির্মাণ বিধি মানা হচ্ছে কি না, এই বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আজ বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদের সাপ্তাহিক বৈঠকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অধ্যাদেশ ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদনকালে প্রধান উপদেষ্টা এই গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ দেন।

বৈঠকের পর বিকেলে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, বর্তমানে রাজউক শুধুমাত্র নিজস্ব এলাকার মধ্যেই ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিতে পারে, কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে একটি নতুন কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়, যা দেশের গ্রামাঞ্চলসহ সব স্থাপনা ও নির্মাণ কাজের অনুমোদন দেবে। একই সঙ্গে তিনি জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড এবং ভূমিকম্প ও অগ্নিঝুঁকির মতো বিষয়গুলো নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের কারণ ও প্রেক্ষাপট

কেন প্রধান উপদেষ্টা একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ দিলেন এবং এই সিদ্ধান্তের পেছনের মূল কারণ।

নিরাপদ নির্মাণ বিধির উদ্বেগ: প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস দেশের নির্মাণ কাজগুলোতে নিরাপদ নির্মাণ বিধি সঠিকভাবে মানা হচ্ছে কি না—তা নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

গ্রামীণ এলাকায় ভবন নির্মাণ: প্রেস সচিব জানান, গ্রামাঞ্চলসহ দেশজুড়ে এখন বহু চার থেকে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড (Bangladesh National Building Code) মেনে তৈরি হচ্ছে কি না, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

ভূমিকম্প ও অগ্নিঝুঁকি: ভূমিকম্প ও অগ্নিঝুঁকির বিষয়টি মাথায় রেখে ভবনগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, তা বাধ্যতামূলকভাবে নিশ্চিত করার জন্য প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন।

রাজউকের সীমাবদ্ধতা: বর্তমানে রাজউকের অনুমোদন ক্ষমতা কেবল নিজস্ব এলাকাতেই সীমাবদ্ধ। সারা দেশের নির্মাণ কাজগুলোতে তদারকি করার মতো একটি কেন্দ্রীয় সংস্থার অভাব রয়েছে, যা নতুন কর্তৃপক্ষ গঠনের মাধ্যমে পূরণ করা হবে।

নতুন রাজউক অধ্যাদেশ ২০২৫-এর মূল বিধান

রাজউক অধ্যাদেশের খসড়ায় কোন কোন নতুন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

পুনর্বিকাশ ও জমি পুনর্বিন্যাস: নতুন অধ্যাদেশে পুনর্বিকাশ (Redevelopment) এবং জমি পুনর্বিন্যাস (Land Readjustment) সংক্রান্ত বিস্তারিত বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জমির মালিকের সম্মতি: এই বিধান অনুযায়ী, জমির মালিকের ন্যূনতম ৬০ শতাংশের সম্মতিতে যেকোনো পুনর্বিকাশ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে। এটি নগর উন্নয়নে গতি আনবে বলে মনে করা হচ্ছে।

জলাশয় ও জলপ্রবাহ সুরক্ষা: জলাশয়, প্রাকৃতিক জলাধার, নিচু জমি ভরাট এবং প্রাকৃতিক জলপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি করা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের বিধান রাখা হয়েছে।

খেলার মাঠ ও উদ্যান: নতুন অধ্যাদেশে খেলার মাঠ ও উদ্যানের শ্রেণি পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণে কঠোর বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা নগরীর পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক হবে।

আইনি কাঠামো ও দণ্ডবিধি

অননুমোদিত নির্মাণ এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে অধ্যাদেশে কী কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে।

নকশা ছাড়া নির্মাণে শাস্তি: নতুন অধ্যাদেশে অননুমোদিত নকশা ব্যতীত নির্মাণ কাজের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে নির্মাণ খাতে বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।

ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা অপসারণ: ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যত্যয়ী স্থাপনা (Non-conforming structures) দ্রুত অপসারণের জন্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং ক্ষমতা রাজউককে দেওয়া হয়েছে।

স্বার্থের সংঘাত (Conflict of Interest) নিয়ন্ত্রণ: রাজউকের চেয়ারম্যান, সদস্য বা কর্মচারীদের রাজউকের সঙ্গে সংযুক্ত কোনো চুক্তি বা শেয়ারে অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এটি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ: এই বিধানগুলো নির্মাণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে আরও স্বচ্ছ ও শক্তিশালী করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

নিরাপত্তা ও নগর পরিকল্পনা

প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনার ফলে নির্মাণ খাত ও নগর পরিকল্পনায় কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

কেন্দ্রীয় তদারকি: একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠিত হলে সারা দেশের নির্মাণ কাজগুলোতে একটি কেন্দ্রীয় তদারকি ব্যবস্থা চালু হবে। ফলে জাতীয় বিল্ডিং কোড বাস্তবায়ন সহজ হবে।

ভূমিকম্প প্রস্তুতি: বাংলাদেশের মতো উচ্চ ভূমিকম্প ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য এই পদক্ষেপটি অত্যন্ত সময়োপযোগী। এটি ভূমিকম্প সহনশীল নির্মাণ নিশ্চিত করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে।

পরিকল্পিত নগরায়ন: নতুন রাজউক অধ্যাদেশে জলাধার ও খেলার মাঠ সুরক্ষার বিধান অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় এটি পরিকল্পিত এবং পরিবেশবান্ধব নগরায়নে সহায়তা করবে।

জনগণের নিরাপত্তা: নিরাপদ নির্মাণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বহুলাংশে বাড়ানো সম্ভব হবে।

শফিকুল আলম (কোট): “প্রধান উপদেষ্টা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করা যায়, যা দেশের সব স্থাপনা ও নির্মাণ কাজের অনুমোদন দেবে। এটি জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য অত্যাবশ্যক।”

বিশেষজ্ঞ মতামত ও চ্যালেঞ্জ

পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন এবং অধ্যাদেশ বাস্তবায়নে বিশেষজ্ঞরা কী ভাবছেন এবং কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে।

বিশেষজ্ঞের দৃষ্টিভঙ্গি: নগর পরিকল্পনাবিদ ও প্রকৌশলীরা প্রধান উপদেষ্টার এই নির্দেশকে দেশের নির্মাণ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানোর জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন। তারা মনে করেন, বর্তমানে সারাদেশে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে ওঠা অপরিকল্পিত ভবনগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ প্রয়োজন ছিল।

বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ: তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই নতুন কর্তৃপক্ষ গঠন ও অধ্যাদেশ বাস্তবায়ন সহজ হবে না। প্রশাসনিক জটিলতা, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা এবং স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের চাপ এই প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে।

প্রয়োজনীয়তা: সফল বাস্তবায়নের জন্য গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়কে দ্রুত একটি শক্তিশালী, দুর্নীতিমুক্ত এবং কারিগরিভাবে সক্ষম কর্তৃপক্ষ গঠনের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। পাশাপাশি, এই কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তিগত সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

ভবিষ্যতের নিরাপদ বাংলাদেশ

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে সারাদেশে ভবন ও নির্মাণ কাজ অনুমোদনে পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের উদ্যোগ বাংলাদেশের অবকাঠামো নিরাপত্তা ও নগর পরিকল্পনায় একটি মৌলিক পরিবর্তন আনতে পারে। নতুন রাজউক অধ্যাদেশের অনুমোদন এবং কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা দেশের রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত নিরাপদ নির্মাণ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করবে বলে আশা করা যায়।

এখন সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হলো দ্রুততম সময়ে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা এবং নতুন কর্তৃপক্ষকে কার্যকরভাবে পরিচালিত করার জন্য একটি স্বচ্ছ ও শক্তিশালী আইনি ও প্রশাসনিক কাঠামো তৈরি করা। যদি এই পদক্ষেপ সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি শুধুমাত্র ভূমিকম্প ও অগ্নিঝুঁকি কমাবে না, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি পরিকল্পিত, বাসযোগ্য ও নিরাপদ বাংলাদেশ গঠনে সহায়তা করবে।

এম আর এম – ২৩৯৫,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button