বাংলাদেশ

ঢাকা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় মেগাসিটি, ২০৫০ সাল নাগাদ শীর্ষে ওঠার সম্ভাবনা

Advertisement

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এখন জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেগাসিটি হিসেবে উঠে এসেছে। জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড আরবানাইজেশন প্রসপেক্ট ২০২৫ শীর্ষক প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। পূর্বে নবম অবস্থানে থাকা ঢাকাকে এই বিশাল উত্থান এক নতুন চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার মুখে দাঁড় করিয়েছে। যে গতিতে ঢাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে যে, ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকাই হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর বা বৃহত্তম মেগাসিটি।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঢাকায় প্রায় ৩ কোটি ৬৬ লাখ মানুষের বসবাস। জনসংখ্যায় তালিকার শীর্ষে রয়েছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা, যেখানে বাস করেন ৪ কোটি ১৯ লাখ মানুষ। আর দীর্ঘদিনের শীর্ষস্থান ধরে রাখা জাপানের রাজধানী টোকিও ৩ কোটি ৩৪ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে তৃতীয় স্থানে নেমে গেছে। এই অভূতপূর্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধি একই সঙ্গে ঢাকা শহরের ওপর চাপ ও সমস্যা বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

মেগাসিটি হিসেবে ঢাকার উত্থান

জনসংখ্যার ভিত্তিতে মেগাসিটির সংজ্ঞা ও বিশ্ব তালিকায় ঢাকার বর্তমান অবস্থান।

  • মেগাসিটি : যেসব শহরে ১ কোটির বেশি মানুষ বসবাস করে, সেগুলোকে সাধারণত মেগাসিটি বলা হয়।
  • বিশ্বের মেগাসিটি: জাতিসংঘের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে মেগাসিটির সংখ্যা ৩৩টিতে পৌঁছেছে, যেখানে ১৯৭৫ সালে ছিল মাত্র আটটি। এই ৩৩টি মেগাসিটির মধ্যে ১৯টিই এশিয়ায় অবস্থিত।
  • ঢাকার অবস্থান: ঢাকা নবম অবস্থান থেকে দ্রুত উপরে উঠে এসে বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেগাসিটি হিসেবে স্থান করে নিয়েছে।
  • শীর্ষে জাকার্তা: বর্তমান তালিকার শীর্ষে আছে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা, যেখানে জনসংখ্যা ৪ কোটি ১৯ লাখ। ঢাকা দ্বিতীয় এবং টোকিও তৃতীয় স্থানে রয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ও প্রধান কারণ

কী কারণে ঢাকার জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর নেপথ্যে থাকা কারণগুলো।

  • গ্রামীণ মানুষের আগমন: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার জনসংখ্যা বাড়ার প্রধান কারণ হলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মানুষের ঢাকায় আগমন
  • জীবিকার তাগিদ: জীবিকার তাগিদে বা কাজের ও সুযোগের সন্ধানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঢাকামুখী হচ্ছে।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব: এছাড়া বন্যা, নদীভাঙন, সমুদ্রস্তরের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগে সবকিছু হারানো মানুষেরাও রাজধানীতে পাড়ি জমাচ্ছেন। এটি জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে আরও দ্রুত করেছে।
  • শহরের পরিধি বৃদ্ধি: প্রতিনিয়ত রাজধানী ঢাকার ভৌগোলিক পরিধি ও আয়তন বেড়ে চলায়ও মোট জনসংখ্যার হিসাব বেড়েছে।

অন্যান্য শীর্ষ মেগাসিটির পরিসংখ্যান

বিশ্বের অন্যান্য প্রধান মেগাসিটিগুলোর বর্তমান জনসংখ্যা ও তুলনামূলক অবস্থান।

  • শীর্ষ ১০-এর চিত্র: শীর্ষ ১০ মেগাসিটির ৯টির অবস্থানই এশিয়াতে। শুধুমাত্র মিসরের রাজধানী কায়রো এশিয়ার বাইরে থাকা শীর্ষ দশের একটি শহর।
  • এশিয়ার মেগাসিটি: জনসংখ্যায় গুরুত্বপূর্ণ এশিয়ার অন্যান্য মেগাসিটিগুলো হলো:
    • নয়াদিল্লি, ভারত: ৩ কোটি ২ লাখ
    • সাংহাই, চীন: ২ কোটি ৯৬ লাখ
    • গুয়াংজু, চীন: ২ কোটি ৭৬ লাখ
    • ম্যানিলা, ফিলিপাইন: ২ কোটি ৪৭ লাখ
    • কলকাতা, ভারত: ২ কোটি ২৫ লাখ
    • সিউল, দক্ষিণ কোরিয়া: ২ কোটি ২৫ লাখ
  • এশিয়ার বাইরে: আমেরিকা অঞ্চলে সবচেয়ে বড় শহর ব্রাজিলের সাও পাওলো (১ কোটি ৮৯ লাখ বাসিন্দা) এবং সাব-সাহারান অঞ্চলের সবচেয়ে বড় শহর নাইজেরিয়ার লাগোস

২০৫০ সালের পূর্বাভাস ও পরিণতি

জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালে ঢাকার কী অবস্থা হতে পারে।

  • শীর্ষে ওঠার সম্ভাবনা: জাতিসংঘ সতর্ক করে বলেছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ ঢাকা হবে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহর বা বৃহত্তম মেগাসিটির শীর্ষ তালিতায় উঠে আসবে।
  • চাপ বৃদ্ধি: এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঢাকা শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা, নাগরিক পরিষেবা, আবাসন, পরিবেশ ও অবকাঠামোর ওপর চরম চাপ সৃষ্টি করেছে।
  • স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকি: অতিরিক্ত জনসংখ্যার কারণে বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং সুপেয় পানির সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করতে পারে।
  • পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা: এই পূর্বাভাস অনুযায়ী, যদি সরকার এখনই সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ না করে, তবে আগামী তিন দশকে ঢাকা মহানগরী বাসযোগ্যতা হারাতে পারে

জাতিসংঘের প্রতিবেদন (কোট): “বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে সব হারিয়েই রাজধানীতে আসছেন মানুষ। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সাল নাগাদ জনসংখ্যায় বৃহত্তম শহরের শীর্ষ তালিতায় উঠে আসবে ঢাকার নাম।”

নিয়ন্ত্রণ ও সুষম উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা

জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে এবং ঢাকাকে বাসযোগ্য রাখতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ।

  • বিকেন্দ্রীকরণ: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ঢাকার ওপর চাপ কমাতে হলে দ্রুত বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধাগুলো ঢাকার বাইরে বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতে সম্প্রসারণ করতে হবে।
  • কর্মসংস্থান সৃষ্টি: প্রত্যন্ত অঞ্চলে নতুন শিল্পাঞ্চল এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, যাতে মানুষকে জীবিকার তাগিদে ঢাকায় আসতে না হয়।
  • পরিকল্পিত শহর: ঢাকাকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে দীর্ঘমেয়াদী, সুষম ও পরিকল্পিত নগর উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। ফুটপাত দখলমুক্ত করা, উন্নত গণপরিবহন ব্যবস্থা চালু করা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি প্রয়োগ করা জরুরি।
  • জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের জন্য দেশের অন্যত্র স্থায়ী ও নিরাপদ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

চ্যালেঞ্জ ও করণীয়

জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেগাসিটি হিসেবে ঢাকার এই উত্থান একই সঙ্গে গর্ব ও গভীর উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে। একদিকে এটি দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু, অন্যদিকে অপরিকল্পিতভাবে বেড়ে ওঠা এই শহর এখন অসহনীয় জনজট, পরিবেশ দূষণ ও জীবনযাত্রার নিম্নমানের কারণে সমালোচিত।

জাতিসংঘের এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য সময়োপযোগী একটি সতর্কবার্তা। ২০৫০ সালের ভয়াবহ জনসংখ্যা বিস্ফোরণের আগে ঢাকাকে বাঁচাতে হলে সরকারকে আরবানাইজেশন প্রসপেক্টকে সামনে রেখে জরুরি ভিত্তিতে বিকেন্দ্রীকরণ, অঞ্চলভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং উন্নত নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যথায়, বিশ্ব মানচিত্রে শীর্ষ জনবহুল শহর হিসেবে ঢাকার নাম এলেও, তা বাসযোগ্যতার দিক থেকে তলানিতে থেকে যাবে।

এম আর এম – ২৩৯০,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button