বাংলাদেশ

ডেঙ্গুতে একদিনে ৩ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ৬১৫

Advertisement

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আবারও বেড়ে চলেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে নতুন করে ৬১৫ জন রোগী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বুধবার (২৬ নভেম্বর ২০২৫) স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়মিত প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, নভেম্বরের শেষ প্রান্তে এসে সংক্রমণ কমার কথা থাকলেও উল্টো বাড়তি চাপ দেখা যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, আবহাওয়ার অনিয়মিত পরিবর্তন, শহর-গ্রাম উভয় অঞ্চলে এডিস মশার বিস্তার, পানি নিষ্কাশন সংকট এবং জনগণের উদাসীনতার কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতির সর্বশেষ চিত্র

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী:

  • গত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু: ৩ জন
  • নতুন ভর্তি রোগী: ৬১৫ জন
  • ঢাকার হাসপাতালে ভর্তি: প্রায় অর্ধেকের বেশি
  • ঢাকার বাইরে ভর্তি: উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী
  • বর্তমানে চিকিৎসাধীন রোগী: কয়েক হাজার
  • এ বছর মোট মৃত্যু: কয়েকশ ছাড়িয়েছে (পূর্বের সরকারি তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সামগ্রিক বিবরণ)

স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, সংক্রমণের হার গত সপ্তাহের তুলনায় কিছুটা ওঠানামা করছে। তবে হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করলে আবারও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থায় চাপ তৈরি হতে পারে।

বর্ষা-পরবর্তী সময়েও কেন বাড়ছে ডেঙ্গু?

সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এবং তার ঠিক পরবর্তী মাসগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি দেখা যায়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নভেম্বর-ডিসেম্বরেও সংক্রমণ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে—

১. আবহাওয়ার অস্বাভাবিকতা

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশের বিভিন্ন এলাকায় তাপমাত্রা দীর্ঘসময় উঁচু থাকে। নভেম্বরেও রাতের তুলনায় দিনের তাপমাত্রা বেশি থাকায় এডিস মশার জীবনচক্র দ্রুত পূর্ণ হয় এবং প্রজনন বেড়ে যায়।

২. শহর-গ্রামে এডিসের বিস্তার

একসময় এডিস মশা মূলত শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন গ্রামাঞ্চলেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ি, বাজার, নির্মাণাধীন ভবন, অযত্নে থাকা পাত্র—সবত্রই মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে।

৩. পানি জমার জায়গা বাড়ছে

নগরীর ড্রেনেজ সমস্যা, নির্মাণস্থান, অপরিকল্পিত নগরায়ণ—এসব কারণে ছোট ছোট জায়গায় পানি জমা থেকে যাচ্ছে, যা এডিস মশার প্রধান প্রজননস্থল।

৪. মানুষের অসচেতনতা

অনেকেই এখনো বাড়ির ভেতর-বাহিরে রাখা পাত্র, ফুলের টব, পুরোনো বোতল কিংবা এয়ারকুলার ইত্যাদি নিয়মিত পরিষ্কার করেন না। এতে অল্প পানি জমলেও মশা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে।

হাসপাতালে বাড়ছে রোগীর চাপ

ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ডেঙ্গু ও জ্বর-জাতীয় রোগে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। বেশ কিছু হাসপাতালে বেড সংকট দেখা দিয়েছে। মশা প্রতিরোধক ব্যবস্থা জোরদার করা হলেও রোগীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ায় হাসপাতাল কর্মীদের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ছে।

রাজধানীর একটি প্রধান সরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন—

“এখনো প্রতিদিন অনেক রোগী আসছেন। কেউ কেউ প্লেটলেট কমে যাওয়ার কারণে শঙ্কায় পড়ে আসছেন। অনেক রোগী চিকিৎসা নিতে দেরি করেন, এতে জটিলতা বাড়ে।”

বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অবস্থাও একই। চিকিৎসকদের মতে, রোগীরা সাধারণত দুই থেকে তিন দিন জ্বর থাকার পর হাসপাতালে আসেন। এ সময় অনেকে মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছে যান।

ডেঙ্গুতে মৃত্যুহার বাড়ার কারণ

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কয়েকটি কারণে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে—

  • চিকিৎসা নিতে দেরি
  • সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় বিলম্ব
  • সেকেন্ডারি ইনফেকশন বা দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হলে ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া
  • বয়স্ক রোগী ও শিশুদের উচ্চমাত্রার ঝুঁকি
  • বিভিন্ন সহ–রোগ থাকা (ডায়াবেটিস, হৃদরোগ ইত্যাদি)

চিকিৎসকদের পরামর্শ, জ্বর তিন দিনের বেশি থাকলে অবশ্যই হাসপাতালে এসে পরীক্ষা করানো উচিত। নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া বা ভিটামিন গ্রহণ করে চিকিৎসা বিলম্ব করা বিপজ্জনক হতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের নতুন নির্দেশনা

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্বাস্থ্য অধিদফতর কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়—

  • প্রতিটি হাসপাতালে আলাদা ডেঙ্গু ইউনিট রাখার নির্দেশ
  • পর্যাপ্ত স্যালাইন ও ওষুধ মজুত নিশ্চিত করা
  • স্থানীয় প্রশাসনকে মশা নিধন কার্যক্রম বাড়ানোর তাগিদ
  • সচেতনতা ক্যাম্পেইন চালানোর নির্দেশ
  • বিভিন্ন স্কুল-কলেজে মশা প্রতিরোধে বিশেষ অভিযান

এছাড়া বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়মিত ডেঙ্গুর বিস্তার পর্যবেক্ষণ করছে। তারা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে নাগরিকদের সচেতনতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

বিশেষজ্ঞদের মতামত: এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে বিপদ বাড়বে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক অধ্যাপক বলেন—
“এডিস মশা এখন আর মৌসুমি নয়। প্রায় সারা বছরই তাদের প্রজনন দেখা যাচ্ছে। শহরগুলোতে প্লাস্টিক বর্জ্য বাড়ায় পানি জমা জায়গা ক্রমেই বাড়ছে। এটি ডেঙ্গুর জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করছে।”

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সমন্বিত উদ্যোগ না নিলে আগামী বছর আরও বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ডেঙ্গুর প্রকোপ

ডেঙ্গুর বিস্তার এবার শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রাজশাহী, রংপুরসহ সব বিভাগেই সংক্রমণ বৃদ্ধির খবর পাওয়া যাচ্ছে।

কিছু অঞ্চলে হাসপাতালগুলোতে বেড সংকট দেখা দিয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন মশা নিধন অভিযান জোরদার করলেও জনশক্তি ও সরঞ্জামের ঘাটতি রয়ে গেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে সরকার, স্থানীয় প্রশাসন, নাগরিক সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। শুধু মশা মারলেই হবে না, প্রজননস্থল ধ্বংস করা জরুরি।

তাদের গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ—

  • প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে ১০ মিনিট বাড়ির ভেতর-বাহির পরিষ্কার করুন
  • ছাদ, বারান্দা, অব্যবহৃত পাত্র, প্লাস্টিক বালতি, টব—কোথাও পানি জমতে দেবেন না
  • জ্বর এলে দ্রুত পরীক্ষা করুন
  • শিশু ও বয়স্কদের বিশেষ যত্ন নিন
  • দিন-রাতে মশারি ব্যবহার করুন
  • অফিস, স্কুল, বাজারসহ জনসমাগমস্থলে পরিচ্ছন্নতা জোরদার করুন

সরকারের পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ

স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন মশা মারার ওষুধ ছিটানো, লার্ভা ধ্বংস, সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাচ্ছে। তবে ঘনবসতিপূর্ণ শহর এলাকায় কাজটি অত্যন্ত কঠিন।

এদিকে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন—

  • সমন্বয়ের অভাব
  • বাজেট সংকট
  • দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি
  • নাগরিকদের অসচেতনতা

এসব কারণে পরিস্থিতি বারবার খারাপের দিকে যায়।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে যা করতে হবে

ডেঙ্গু প্রতিরোধে চিকিৎসকেরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন—

  • বাড়ির ভেতর-বাহিরে কোথাও পানি জমতে দেবেন না
  • মশারি ব্যবহার বাড়ান
  • সবসময় শরীর ঢেকে রাখে এমন পোশাক পরুন
  • স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের সচেতন করুন
  • অফিস-বাসা পরিচ্ছন্ন রাখুন
  • জ্বর হলে নিজে ওষুধ না খেয়ে সঠিক পরীক্ষার ওপর নির্ভর করুন

ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি আবারও সতর্কবার্তা দিচ্ছে—ব্যক্তিগত ও সামাজিক সচেতনতা না বাড়ালে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। প্রতিদিনের মৃত্যু ও ভর্তি রোগীর সংখ্যা দেখেই বোঝা যায়, রোগটি এখনই নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে শীত মৌসুমেও এর প্রভাব থাকতে পারে।

স্বাস্থ্য অধিদফতর, স্থানীয় প্রশাসন, চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা জনসাধারণের সহযোগিতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন। সবাই নিজেদের অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালন করলে ডেঙ্গুর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব।

MAH – 14006 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button