বাংলাদেশ

ইসকন হামলায় আইনজীবী আলিফ হত্যা, ১৮ আসামি অধরা

Advertisement

চট্টগ্রামে আলোচিত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা মামলার এক বছর পার হলেও এখনো অধরা অন্তত ১৮ জন আসামি। রাষ্ট্রীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্ত, গ্রেপ্তারের অগ্রগতি ও বিচার প্রক্রিয়ার ধীরগতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন নিহতের পরিবার, সহকর্মী আইনজীবী ও আদালতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

মামলার ৩৯ জন আসামির মধ্যে ২১ জন গ্রেপ্তার হলেও ১৮ জন এখনো পলাতক, যা স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থাকে গুরুতরভাবে বাধাগ্রস্ত করছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

নিহত আলিফের পরিবার বলছে—
“এক বছর পার হয়ে গেলেও আলিফ হত্যাকারীরা বিচারের মুখোমুখি হয়নি। এটি আমাদের পরিবারের জন্য গভীর বেদনা। বিচারহীনতার এই পরিস্থিতি রাষ্ট্রীয় দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি।”

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমাজও একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছে—
“একজন তরুণ আইনজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা বছরের পর বছর ঝুলে থাকতে পারে—এটাই প্রমাণ করে আইনজীবী সমাজ কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে।”

এক বছর পূর্তি উপলক্ষে চট্টগ্রাম কোর্টহিলে মানববন্ধন

২৬ নভেম্বর সকাল ১০টার দিকে চট্টগ্রাম কোর্টহিলে আইনজীবীরা বৃহৎ মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে শতাধিক আইনজীবী উপস্থিত ছিলেন।

সেখানে বক্তারা বলেন—

  • আলিফ হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করতে হবে
  • মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর দাবি জানানো হচ্ছে
  • একজন আইনজীবীকে হত্যার ঘটনা বিচার বিভাগ ও আইনের প্রতি সরাসরি চ্যালেঞ্জ
  • বিচার বিলম্বিত হলে সাধারণ মানুষের আইনের প্রতি আস্থা কমে যাবে

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এডভোকেট আবদুস সাত্তার বলেন:
“অপরাধীরা যখন বছরের পর বছর পলাতক থেকে যায়, তখন আইনের প্রতি মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়। আমরা চাই অবিলম্বে সব আসামিকে গ্রেপ্তার করে বিচার শুরু করা হোক।”

সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট ফজলুল বারী বলেন:
“আলিফ ছিল আমাদের সহকর্মী, এক উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আইনজীবী। তাকে দিনের আলোয় হত্যার পরও বিচার ধীরগতিতে চলছে—এটি অত্যন্ত দুঃখজনক।”

মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন জেলা পিপি এডভোকেট আশরাফ হোসেন চৌধুরী রাজ্জাক, মহানগর পিপি মো. মফিজুল হক ভূঁইয়া, সিনিয়র আইনজীবীসহ শতাধিক আইনজীবী।

আলিফ হত্যা মামলা কোন পর্যায়ে?

আদালত সূত্র বলছে—

  • মামলাটি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে রয়েছে
  • আগামী ১ ডিসেম্বর মামলার পরবর্তী তারিখ
  • মোট আসামি ৩৯ জন
  • অভিযোগপত্রে সবার নামই রয়েছে
  • এর মধ্যে ২১ জন গ্রেপ্তার
  • ১৮ জন পলাতক

পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, হুলিয়া এবং সম্পদ ক্রোকের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে আইনজীবীদের দাবি—
“এত বড় একটি হত্যাকাণ্ডের আসামিরা বছরজুড়ে দেশের ভেতরেই কীভাবে লুকিয়ে থাকতে পারে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও কঠোর অভিযান প্রয়োজন।”

বিচার ধীরগতির কারণ কী?

১. পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারে ধীরগতি

মামলায় যেহেতু ১৮ জন আসামি এখনো ধরা পড়েনি, আদালত অভিযোগ গঠন করতে পারছে না।
আইনজীবীদের মতে, ইসকন সংগঠনের প্রভাবশালী একটি অংশ আসামিদের পালাতে সাহায্য করছে।

২. মামলাটি এখনো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যায়নি

এ ধরনের হত্যাকাণ্ডে সাধারণত রাষ্ট্রীয়ভাবে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর নিয়ম থাকলেও এখানে তা হয়নি।
নিহত আলিফের সহকর্মী আইনজীবী রায়হানুল ওয়াজেদ চৌধুরী বলেন:
“এটি সাধারণ কোনো মামলা নয়। একজন আইনজীবীকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে। অথচ রাষ্ট্র এখনো মামলাটি দ্রুত বিচারে দেয়নি।”

৩. একাধিক মামলার জটিলতা

আলিফ হত্যার ঘটনায় মোট সাতটি মামলা হয়েছে।
এই মামলাগুলো ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আদালতে চলতে থাকায় পুরো প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে।

গত বছরের ২৬ নভেম্বর কী ঘটেছিল?

২০২৪ সালের ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের আদালতপাড়ায় ভয়াবহ সহিংসতার ঘটনা ঘটে।

সেদিন বহিষ্কৃত ইসকন নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশকে আদালতে হাজির করা হলে তার অনুসারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষ শুরু হয়।
পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

ইসকন অনুসারীরা—

  • মসজিদে হামলা
  • দোকানপাটে ভাঙচুর
  • গাড়ি পোড়ানো
  • আদালতপ্রাঙ্গণে পুলিশকে আক্রমণ

এতে স্থানীয় জনতা ও ব্যবসায়ীরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে তরুণ আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে রঙ্গম কনভেনশন হলের গলিতে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
শহরজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

নিহত আলিফের বয়স ছিল মাত্র ২৮ বছর।
চট্টগ্রাম আদালতে তার কর্মজীবন মাত্র শুরু হয়েছিল।

পরিবারের বেদনা: “আমরা কি ন্যায়বিচার পাবো না?”

আলিফের বাবা জামাল উদ্দিন হত্যা মামলার বাদী।
তিনি বলেন—
“আমার ছেলেকে সামনে থেকে কুপিয়ে হত্যা করা হলো। পুরো দেশ দেখল সেই দৃশ্য। কিন্তু এক বছরেও বিচার শুরু হলো না। আমরা কি তবে কখনো বিচার পাবো না?”

আলিফের ভাই বলেন—
“আমাদের পরিবারের জন্য এটি শুধু একটি মামলা নয়—এটি ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। আমরা রাষ্ট্রের কাছে দাবি জানাই, সব আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হোক।”

এ পর্যন্ত কতগুলো মামলা?

আলিফ হত্যার পর মোট ৭টি মামলা দায়ের হয়।

১. পুলিশ বাদী হয়ে ৭৯ জনের বিরুদ্ধে ৩টি মামলা
২. আলিফের বাবা বাদী হয়ে ৩১ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা
৩. আলিফের ভাই বাদী হয়ে ১১৬ জনের নামে আরেকটি মামলা
৪. ব্যবসায়ী মোহাম্মদ উল্লাহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা
৫. মো. এনামুল হক ১৬৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন

এই মামলাগুলোতে মোট আসামির সংখ্যা ৪০০–র বেশি।
এত বড় মামলার তদন্তে সময় লাগলেও আইনজীবীদের মতে, “এক বছর সময় কোনোভাবেই স্বাভাবিক নয়।”

আইনজীবী সমিতির বক্তব্য: “রাষ্ট্রের আরও কঠোর ভূমিকা প্রয়োজন”

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ হাসান আলী চৌধুরী বলেন—
“এটি একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন আইনজীবীকে হত্যা করে আসামিরা এখনো ধরা পড়েনি। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আরও দৃঢ় অবস্থান নেওয়া জরুরি।”

তিনি আরও বলেন—
“আমরা দাবি জানাচ্ছি, মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হোক। প্রয়োজনে আমরা নিজেরাও আবেদন করব।”

মানববন্ধন, দোয়া মাহফিল ও স্মরণসভা

আলিফের প্রথম শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে—

  • স্মরণসভা
  • দোয়া মাহফিল
  • কালো ব্যাজ ধারণ
  • আদালতে নীরবতা পালন
  • মানববন্ধন

চট্টগ্রাম আদালতপ্রাঙ্গণে এসব আয়োজন করা হয়েছে।
সেখানে সহকর্মীরা বলেন—
“একজন আইনজীবীর হত্যাকারী ধরা না পড়লে বার কাউন্সিলের নিরাপত্তাও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।”

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বক্তব্য

তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে—

  • পলাতক আসামিদের অবস্থান শনাক্তে একাধিক জেলা ও সীমান্ত এলাকায় অভিযান চলছে
  • আসামিদের কেউ কেউ দেশে নেই
  • আবার কেউ কেউ বিভিন্ন এলাকায় নাম–পরিচয় বদলে লুকিয়ে রয়েছে

তবে আইনজীবীরা বলছেন—
“এগুলো অজুহাত নয়। প্রয়োজন হলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা চাইতে হবে।”

বিচার না হলে কী প্রভাব পড়বে?

বিশেষজ্ঞদের মতে—

  • আইনজীবী সমাজের মনোবল কমে যাবে
  • আদালতের নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে
  • সাম্প্রদায়িক উগ্রতা আরও বাড়তে পারে
  • বিচারহীনতার সংস্কৃতি শক্তিশালী হবে
  • সাধারণ মানুষের মনে সরকারের প্রতি আস্থা কমবে

একজন সিনিয়র আইনজীবী বলেন—
“আলিফ হত্যার বিচার শুধু একটি পরিবারের দাবি নয়—রাষ্ট্রের আইন ও বিচারব্যবস্থার প্রতি মানুষকে আস্থাশীল রাখার জন্যও খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”

দ্রুত বিচার ও আসামিদের গ্রেপ্তার এখন সময়ের দাবি

এক বছর ধরে চলে আসা বিচার বিলম্ব এবং পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তার না হওয়া—
নিহত আলিফের পরিবার, সহকর্মী আইনজীবী, সমাজ, এমনকি বিচার ব্যবস্থার জন্যও উদ্বেগের বিষয়।

চট্টগ্রামের আইনজীবীরা আবারও দাবি তুলেছেন—
“সব আসামিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করা হোক এবং মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হোক।”

সারা দেশের আইনজীবী সমাজেরও একই প্রত্যাশা—
“সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যার বিচার যেন আর বিলম্বিত না হয়।”

MAH – 14005 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button