কড়াইল অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে সহায়তা করবে সরকার: প্রধান উপদেষ্টা
ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তিগুলোর একটি কড়াইল। এখানে কয়েক লাখ মানুষ বাস করে, যারা রাজধানীর নানান প্রতিষ্ঠান, বাজার, বাসাবাড়ি ও অফিসে কাজ করেন। নিম্ন আয়ের এই মানুষেরা প্রধানত গার্মেন্টস শ্রমিক, রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহকর্মী, ফেরিওয়ালা– যারা প্রতিদিনের আয়ের ওপর নির্ভর করে বাঁচেন। তাদের জীবনের নিরাপত্তা ও স্থায়িত্ব কখনও খুব শক্ত ভিত্তিতে দাঁড়িয়ে থাকে না। ঠিক এমনই সময়ে হঠাৎ নেমে এলো ভয়াবহ বিপর্যয়—এক দুঃসহ অগ্নিকাণ্ড।
কড়াইল বস্তির ভয়াবহ আগুন শুধু ঘর-বাড়িই পুড়িয়ে দেয়নি, কেড়ে নিয়েছে মানুষের বহু বছরের সঞ্চয়, নিরাপত্তা, এবং স্থিতির অনুভূতি। এই দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, সরকার দ্রুত পুনর্বাসনসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহায়তা নিশ্চিত করবে।
অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা: মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে আগুন
সোমবার গভীর রাতে কড়াইল বস্তির মধ্যভাগে হঠাৎ আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, প্রথমে একটি টিনশেড ঘর থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা যায়। অল্প সময়ের মধ্যেই আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং একের পর এক ঘর লেলিহান শিখায় জ্বলে ওঠে। বাতাসের প্রবাহ ও বস্তির টিন-কার্ডবোর্ড কাঠামোর কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ফায়ার সার্ভিসের একাধিক ইউনিট রাতভর আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। আগুন নেভাতে সময় লেগে যায় দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা। অগ্নিকাণ্ডের মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে একাধিক ফায়ার সার্ভিস সদস্যও আহত হন।
প্রাথমিক হিসেবে জানা গেছে—
- পোড়েছে প্রায় ১২০০–১৫০০ ঘর
- গৃহহীন হয়েছে প্রায় ৬ থেকে ৮ হাজার মানুষ
- নষ্ট হয়েছে বাড়ির মাল-পত্র, আসবাব, পোশাক, বই, নথি—সবই
- অনেকের দোকান, ছোট ব্যবসা ও কর্মসংস্থান সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস
বস্তির সরু গলি, পানির পর্যাপ্ত উৎস না থাকা এবং হঠাৎ আগুনের তীব্রতার কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হয়ে যায়।
ক্ষতিগ্রস্তদের আর্তনাদ: “সবকিছু পুড়ে ছাই হয়ে গেল”
বস্তিবাসীদের আহাজারি ও আতঙ্ক যেনো পুরো এলাকায় তৈরি করেছে বেদনাদায়ক পরিবেশ। কেউ সন্তানকে নিয়ে নিরাপদ স্থানে ছুটেছেন, কেউ বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন সামান্য যে মালপত্র ছিল তা। তবে বেশিরভাগ বাসিন্দা বলছেন—
“ঘর-বাড়ি যা ছিল সব পুড়ে গেছে, হাতে এখন আর কিছুই নেই।”
অনেকে শিক্ষার্থীর বই-খাতা, সার্টিফিকেট, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র হারিয়ে হতাশ। বিশেষ করে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা বলেছেন, পড়াশোনার সব উপকরণ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা গভীর সংকটে পড়েছেন।
প্রধান উপদেষ্টার উদ্বেগ ও সহায়তার ঘোষণা
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গভীর শোক প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার রাতে এক বিবৃতিতে বলেন—
“কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডে বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়েছে, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন ও প্রয়োজনীয় সব সহায়তা নিশ্চিত করতে সরকার সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করবে।”
তিনি আরও বলেন—
“এই দুর্ঘটনায় যারা আহত হয়েছেন, তারা দ্রুত সুস্থ হোন—এই কামনা করি। সরকার পাশে আছে এবং থাকবে।”
তার নির্দেশে ঢাকা জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও সামাজিক সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে মাঠে নেমেছে।
সরকারের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশের পর প্রশাসন যেসব কার্যক্রম শুরু করেছে—
১. অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র
- স্কুল ভবন, কমিউনিটি সেন্টার ও খোলা মাঠে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে
- শিশু, নারী ও বয়স্কদের জন্য আলাদা সুরক্ষা ব্যবস্থা
২. খাদ্য ও ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ
- চাল, ডাল, তেল, শুকনো খাবার বিতরণ
- শিশুদের জন্য দুধ, স্যালাইন ও জরুরি খাবার
৩. চিকিৎসা সহায়তা
- প্রাথমিক চিকিৎসা ক্যাম্প স্থাপন
- ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট, দগ্ধ ও আহতদের চিকিৎসা
৪. ক্ষতিগ্রস্তের তালিকা প্রণয়ন
- প্রতিটি পরিবারের ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ
- তথ্য সংগ্রহ শেষে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান
৫. নিরাপত্তা জোরদার
- পুলিশ ও র্যাব মোতায়েন
- আগুনের উৎস তদন্তে বিশেষ দল গঠন
কড়াইল বস্তি: অগ্নিকাণ্ডের ইতিহাস বারবার কেন ঘটে?
কড়াইল বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড নতুন কিছু নয়। গত ১০ বছরে একাধিক বড় অগ্নিকাণ্ড ঘটে উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। এর প্রধান কারণগুলো—
- ঘরগুলো টিন ও কাঠে নির্মিত, যা সহজেই দাহ্য
- বৈদ্যুতিক লাইন ঝুলে থাকে, অনিয়ন্ত্রিত কানেকশন
- সরু গলি, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ঢোকা কঠিন
- পানির উৎস ও প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই
প্রতিবারের মতো এবারও আগুন লাগার কারণ নিয়ে তদন্ত চলছে। প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী, শর্ট সার্কিট বা গ্যাসের চুলা থেকে আগুন ছড়াতে পারে।
পুনর্বাসন কি হবে স্থায়ী? দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
প্রতিবার আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হলে অস্থায়ী ঘর নির্মাণ হয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
- স্থায়ী পুনর্বাসন
- নিরাপদ আবাসন
- সঠিক নগর পরিকল্পনা
- বৈদ্যুতিক সংযোগের সঠিক ব্যবস্থা
- অগ্নিনির্বাপণ প্রশিক্ষণ
এসব ছাড়া একই বিপর্যয় বারবার ঘটবে।
এ বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন, সরকার চাইলে সরকারি জমিতে বহুতল ভবনে নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য স্থায়ী আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলতে পারে।
অগ্নিকাণ্ডে শিক্ষার্থীদের বিপর্যস্ত অবস্থা
কড়াইলে প্রায় ২০–২৫ হাজার শিক্ষার্থী বসবাস করে। তাদের মধ্যে বহুজনের—
- বই-খাতা
- ইউনিফর্ম
- স্কুল সরঞ্জাম
- সার্টিফিকেট
সবই আগুনে পুড়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন বই বিতরণ করা হবে এবং পরিচয় যাচাইয়ের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ কাগজ পুনরায় দেওয়া হবে।
মানবিক সহায়তায় এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন সংগঠন
অগ্নিকাণ্ডের পরপরই বেশকিছু সামাজিক সংগঠন, স্বেচ্ছাসেবক, ছাত্র সংগঠন, এনজিও ও সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়িয়েছে।
তারা দিচ্ছেন—
- পোশাক
- কম্বল
- ওষুধ
- খাবার
- বিশুদ্ধ পানি
এ ছাড়া অনেকেই ফেসবুকসহ সামাজিক মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করে সহায়তা করছেন।
আগুনের উৎস অনুসন্ধানে তদন্ত কমিটি
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, আগুনের সঠিক উৎস জানতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা বস্তির অভ্যন্তরের বৈদ্যুতিক অবস্থা, গ্যাস ব্যবহারের ধরন ও আগুন ছড়ানোর দিকসহ সব কিছু পরীক্ষা করবে।
তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা প্রতিরোধে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
ক্ষতিগ্রস্তদের প্রত্যাশা: “নিরাপদ থাকার জায়গা চাই”
বস্তিবাসীরা বলছেন—
- শুধু ত্রাণ দিলে হবে না
- প্রয়োজন নিরাপদ ও স্থায়ী বাসস্থান
- যেন বারবার নতুন করে ঘর বানাতে না হয়
- কর্মসংস্থানের সুযোগ বজায় থাকে
সরকার যদি স্থায়ী পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয় তবে তারা একটি নিরাপদ জীবনের স্বপ্ন দেখতে পারবেন।
সম্পাদকীয় দৃষ্টিকোণ (বিশ্লেষণমূলক)
কড়াইল বস্তির অগ্নিকাণ্ড শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি দেশের শহুরে দারিদ্র্যের জটিল বাস্তবতাকে সামনে এনেছে। নিম্ন আয়ের মানুষ রাজধানীর প্রতিটি সেক্টরের জন্য অপরিহার্য—তবু তাদের নিরাপদ বাসস্থানের নিশ্চয়তা নেই।
প্রধান উপদেষ্টার পুনর্বাসনের ঘোষণা অবশ্যই আশার আলো। এখন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—
- ঘোষণা বাস্তবে কত দ্রুত কার্যকর হয়
- ক্ষতিপূরণ কতটা যথাযথভাবে পৌঁছে
- দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ বস্তি অঞ্চলে পরিকল্পিত পুনর্বাসন কার্যক্রম নেওয়া হয় কি না
অগ্নিকাণ্ডের মতো দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার ওপর গুরুত্বারোপ করা খুবই জরুরি।
কড়াইল বস্তির ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড মানুষের জীবনে যে ট্র্যাজেডি তৈরি করেছে তা পুষিয়ে নেওয়া সহজ নয়। তবে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের স্পষ্ট ঘোষণা—
“ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পুনর্বাসনে সরকার সব ধরনের সহায়তা দেবে”
এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় আশ্বাস।
সরকার, প্রশাসন, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এবং সাধারণ মানুষের যৌথ প্রচেষ্টা এই দুর্যোগ মোকাবিলায় বড় ভূমিকা রাখছে। এখন দরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা এবং বস্তিবাসীর জন্য নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ নিশ্চিত করা।
MAH – 13993 I Signalbd.com



