দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আবারও তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে ৬৩৩ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং এই সময়ে একজন ডেঙ্গু রোগী মারা গেছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, আক্রান্তদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশি রোগী কেবল রাজধানী ঢাকার হাসপাতালগুলোতেই ভর্তি হয়েছেন। ঢাকা মহানগরীতেই আক্রান্তের সংখ্যা ২১৭ জন, যা দেশজুড়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে এই তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। এই পরিসংখ্যান চলতি বছরের ডেঙ্গু পরিস্থিতির ভয়াবহতাকেই তুলে ধরছে। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট ৩৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ৯১ হাজার ৬০২ জন ছাড়িয়ে গেছে। ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য বিভাগকে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টার ডেঙ্গু চিত্র ও ঢাকা মহানগরের উদ্বেগ
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত সময়ের পরিসংখ্যানে ঢাকার পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ।
- মোট আক্রান্ত ও মৃত্যু: গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে নতুন করে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৩৩ জন। এই সময়ে মারা গেছেন ১ জন।
- বিভাগভিত্তিক চিত্র (২৪ ঘণ্টা):
- ঢাকা মহানগর (দুই সিটি করপোরেশন): ২১৭ জন
- ঢাকা বিভাগ (সিটি করপোরেশন বাদে): ১২৬ জন
- চট্টগ্রাম বিভাগ: ৮৬ জন
- বরিশাল বিভাগ: ৮২ জন
- খুলনা বিভাগ: ৪৭ জন
- ময়মনসিংহ বিভাগ: ৪০ জন
- রাজশাহী বিভাগ: ২৩ জন
- রংপুর বিভাগ: ৬ জন
- সিলেট বিভাগ: ৬ জন
- উদ্বেগের কারণ: রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শয্যা সংকট ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার উপর চাপ বাড়ছে। ২১৭ জন আক্রান্তের এই পরিসংখ্যান স্পষ্ট করে যে, ডেঙ্গুর প্রধান হটস্পট এখনো ঢাকা মহানগর।
মাসভিত্তিক পরিসংখ্যান ও চলতি বছরের ভয়াবহতা
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ইতোমধ্যে ৯১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। মাসভিত্তিক এই পরিসংখ্যান ডেঙ্গুর প্রকোপের সময়কাল নির্দেশ করে।
- জানুয়ারি থেকে বর্তমান (২৫ নভেম্বর): চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯১ হাজার ৬০২ জন এবং মারা গেছেন ৩৬৭ জন।
- গত বছরের তুলনা: স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন। যদিও ২০২৩ সালের তুলনায় আক্রান্তের সংখ্যা বর্তমানে কম, তবে সংক্রমণের গতি ও মৃত্যুর হার জনস্বাস্থ্যকে ভাবিয়ে তুলছে।
- ২০২৪ সালের পরিসংখ্যান: পূর্বের বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন এবং মোট মৃত্যুবরণ করেন ৫৭৫ জন।
বিশেষজ্ঞ মতামত: ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের কারণ ও প্রতিরোধ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, ডেঙ্গুর এমন প্রাদুর্ভাবের পেছনে রয়েছে কিছু কাঠামোগত দুর্বলতা এবং অসচেতনতা।
- মশার ঘনত্ব: কীটতত্ত্ববিদরা মনে করেন, নভেম্বর মাসেও রাজধানীতে এডিস মশার ঘনত্ব কমেনি। অপর্যাপ্ত ফগিং এবং মশা নিধনে কার্যকর ওষুধের অভাব এই প্রাদুর্ভাবকে দীর্ঘায়িত করছে।
- জলবায়ু পরিবর্তন: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের ধরনে পরিবর্তন আসায় এডিস মশার প্রজনন মৌসুম দীর্ঘ হয়েছে। বৃষ্টি থেমে যাওয়ার পরও জমে থাকা পানিতে এডিসের বংশবিস্তার অব্যাহত রয়েছে।
- সচেতনতার অভাব: অনেকেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক উপসর্গকে সাধারণ ভাইরাল ফ্লু মনে করে দেরিতে হাসপাতালে আসছেন। ফলে রোগীর অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যাওয়ায় মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও হাসপাতালগুলোর চ্যালেঞ্জ
রাজধানীতে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ায় হাসপাতালগুলোর উপর চরম চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
- শয্যা সংকট: সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য নির্ধারিত শয্যা দ্রুত পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। নতুন রোগী ভর্তির জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
- প্লাটিলেট ও রক্তচাপ: বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার ডেঙ্গুর ধরন কিছুটা ভিন্ন। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে দ্রুত প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে এবং রক্তচাপ মারাত্মকভাবে ওঠানামা করছে, যা চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্কতার দাবি রাখে।
- জরুরি পদক্ষেপ: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিটি হাসপাতালকে ডেঙ্গু ওয়ার্ডে পর্যাপ্ত জনবল ও চিকিৎসা সামগ্রী নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছে। বিশেষ করে ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট এবং শক সিনড্রোমের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুতি বাড়াতে বলা হয়েছে।
ডা. আব্দুল মতিন, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ (কোট): “নভেম্বর মাসেও ডেঙ্গুর এই প্রকোপ অত্যন্ত উদ্বেগজনক। সিটি করপোরেশনকে মশা নিধনে বছরব্যাপী কার্যকর পরিকল্পনা নিতে হবে এবং নাগরিকদের ঘরে ঘরে জমে থাকা পানি অপসারণে আরও কঠোর হতে হবে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে এখন আর মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করার সুযোগ নেই।”
প্রতিরোধে নাগরিকদের করণীয় ও কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব
ডেঙ্গু প্রতিরোধে ব্যক্তিগত সচেতনতা এবং সিটি করপোরেশনের ভূমিকা উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
- ব্যক্তিগত সচেতনতা: নাগরিকদের প্রধান কর্তব্য হলো তাদের বাসাবাড়ি, বারান্দা ও ছাদের জমে থাকা পানি নিয়মিত (কমপক্ষে তিন দিন পর পর) ফেলে দেওয়া। এডিস মশা স্বচ্ছ ও স্থির পানিতে জন্ম নেয়। দিনের বেলা ঘুমানোর সময়ও মশারি ব্যবহার করা উচিত।
- কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব:
- বছরব্যাপী কর্মসূচি: সিটি করপোরেশনকে কেবল বর্ষা মৌসুমে নয়, সারা বছর ধরে মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
- কার্যকর কীটনাশক: মশার লার্ভা ও পূর্ণাঙ্গ মশা নিধনে ব্যবহৃত কীটনাশকের কার্যকারিতা নিয়মিত পরীক্ষা করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তন করা জরুরি।
- জনসচেতনতা বৃদ্ধি: গণমাধ্যমের মাধ্যমে এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা আরও বাড়াতে হবে।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় সম্মিলিত উদ্যোগের আহ্বান
রাজধানী ঢাকাসহ দেশজুড়ে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং মৃত্যুর ঘটনা জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি। ঢাকা মহানগরে ২১৭ জন আক্রান্তের পরিসংখ্যান নির্দেশ করে যে, এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র এখনো মারাত্মকভাবে সক্রিয়। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার, সিটি করপোরেশন এবং জনগণের সম্মিলিত ও নিরবচ্ছিন্ন উদ্যোগ অপরিহার্য। মশার প্রজনন স্থান ধ্বংস করা এবং আক্রান্ত রোগীদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এই প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আসন্ন শুষ্ক মৌসুমের আগে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমিয়ে আনার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
এম আর এম – ২৩৭০,Signalbd.com



