বাংলাদেশ

ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন এমপি-মন্ত্রী হলে শরীয়াহ আইন বাস্তবায়ন সম্ভব: ধর্ম উপদেষ্টা

Advertisement

বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারণী অঙ্গনে ধর্মীয় জ্ঞানের গুরুত্ব নতুন করে সামনে এসেছে। ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিরা যদি জাতীয় নেতৃত্বে আসতে পারেন, তবে দেশে শরীয়াহভিত্তিক ন্যায়বিচার ও পরিবারের সার্বিক কল্যাণমূলক আইন বাস্তবায়ন আরও সহজ হবে বলে মন্তব্য করেছেন ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন।

সোমবার জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে বাংলাদেশ মসজিদ মিশন আয়োজিত ‘মুসলিম পারিবারিক আইন ও বাংলাদেশ প্রেক্ষিত’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। সেমিনারে দেশের শীর্ষ ইসলামি চিন্তাবিদ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আইন বিশেষজ্ঞ এবং গবেষকরা অংশ নেন।

ধর্ম উপদেষ্টা বলেন, “ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন এমপি, মন্ত্রী, স্পিকারসহ জাতীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে পারলে শরীয়াহ ভিত্তিক ন্যায়পরায়ণ সমাজ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন অনেক সহজ হবে। রাজনীতির সঙ্গে নৈতিকতা ও ধর্মীয় উপলব্ধির সংযোগ স্থাপন করতে পারলে জাতির চরিত্র বদলে যাবে। রাজনীতির চেহারা বদলে যাবে।”

তার মতে, দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশে আলেম-ওলামাদের অবস্থান দৃশ্যমানভাবে শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু এই ঐক্য যদি টেকসই না হয়, তবে অর্জিত অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হবে।

সেমিনারের মূল বার্তা: বাংলাদেশে পারিবারিক আইন নিয়ে নতুন আলোচনার দ্বার

বর্তমান সময়ের পারিবারিক ও সামাজিক সংকটগুলোকে সামনে রেখে বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের এই আয়োজন বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বলে উপস্থিত বক্তারা মত দেন।

বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইন—বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার, ভরণপোষণ, হেফাজত, যৌতুকের সমস্যা বা পারিবারিক বিবাদের মতো বাস্তব বিষয় নিয়ে প্রতিদিন বহু মানুষ ভোগান্তিতে পড়েন। দেশজুড়ে ধর্মীয় বিধানের সাথে আধুনিক আইনি কাঠামোর মিল—এটি এখন বড় আলোচনার বিষয়।

এই প্রেক্ষাপটে শরীয়াহ-সমর্থিত কিন্তু আধুনিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রণীত ন্যায়সঙ্গত পারিবারিক আইন এখন সময়ের দাবি বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে ভুল ব্যাখ্যার ঝুঁকি বাড়ে

সেমিনারে বক্তারা বলেন, পারিবারিক আইন ইসলামের একটি সংবেদনশীল ক্ষেত্র। এর ব্যাখ্যা ও প্রয়োগে ধর্মীয় জ্ঞান, হাদিস-আল-কুরআনের নির্দেশনা এবং ফিকাহর গভীর বোধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ধর্ম উপদেষ্টা ড. খালিদ হোসেন বলেন, “ধর্মীয় আইনের ভুল ব্যাখ্যা জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। আর এই ভুল ব্যাখ্যা তখনই ঘটে যখন নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ধর্মীয় জ্ঞানের ঘাটতি থাকে। সমাজের নেতৃত্বে যদি এমন মানুষ আসেন, যারা কুরআন-সুন্নাহ সম্পর্কে অভিজ্ঞ ও সম্যক ধারণা রাখেন, তবে জাতীয় পর্যায়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্ভব হবে।”

তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্ব মুসলিম সমাজে শরীয়াহভিত্তিক আইন প্রয়োগে যে সব দেশ সফল হয়েছে, তারা সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব গড়ে তুলেছে। সেসব দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক ব্যবস্থা অনেক বেশি স্থিতিশীল ও ন্যায়সংগত।

“৫৪ বছর পর আলেম-ওলামারা শক্ত অবস্থানে”—ড. খালিদ হোসেন

বক্তৃতার এক পর্যায়ে ড. খালিদ হোসেন বলেন,
“৫৪ বছর পর বাংলাদেশের আলেম-ওলামারা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছেন। শিক্ষা, গবেষণা, সামাজিক কাজ—সব ক্ষেত্রেই তাঁদের অবদান বাড়ছে। কিন্তু এই শক্ত অবস্থান বজায় রাখতে হলে তাঁদের মধ্যে ঐক্য এবং পারস্পরিক সম্প্রীতি আরও জোরদার করতে হবে।”

তিনি আরও বলেন, সমাজে ধর্মীয় নেতৃত্বের ভূমিকা কেবল মসজিদ-মাদরাসা পরিচালনায় সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। বরং তাঁদের উচিত রাষ্ট্র পরিচালনা, সামাজিক সংস্কার এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখা।

মুসলিম পারিবারিক আইন: সমাজের ভিত্তিকে দৃঢ় করার হাতিয়ার

সেমিনারে আলোচকরা বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন শুধু ব্যক্তিগত সম্পর্ক নয়, বরং সমাজের ভিত্তি তৈরি করে। একটি পরিবার ভেঙে যাওয়া মানে পুরো সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়া।

এই আইনগুলো ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে—

  • বিবাহ প্রতিষ্ঠান আরও শক্তিশালী হবে
  • পারিবারিক বিবাদ কমবে
  • নারী-পুরুষের অধিকার স্পষ্ট হবে
  • উত্তরাধিকার বণ্টনে ন্যায় প্রতিষ্ঠা সহজ হবে
  • সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত হবে

ফলে জাতীয় পর্যায়ে স্থিতিশীলতা ও নৈতিকতার উন্নতি ঘটবে।

শিক্ষিত নেতৃত্বই শরীয়াহ বাস্তবায়নের জন্য অপরিহার্য

ড. খালিদ হোসেন বলেন, “এমপি-মন্ত্রী বা কোনো উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি ধর্মীয় জ্ঞান ছাড়া থাকে, তবে শরীয়াহ আইন কীভাবে প্রয়োগ হবে? যে আইন বুঝবে না, সে আইন বাস্তবায়ন করবে কীভাবে?”

তিনি যুক্তি দেন, শরীয়াহ আইন প্রণয়ন বা সংস্কারের জন্য যেমন ধর্মীয় জ্ঞান প্রয়োজন, তেমনি এর বাস্তবায়নে প্রয়োজন আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ধারণা। এই দুই জ্ঞানের সমন্বয়েই একজন প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে ওঠে।

বক্তারা বললেন: ধর্মীয় মূল্যবোধ ছাড়া আইন অপূর্ণ

সেমিনারে অংশ নেওয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্য চিন্তাবিদেরা বলেন, বাংলাদেশ একটি মুসলিম-প্রধান দেশ; দেশের মানুষ শত শত বছর ধরে ইসলামি আইন ও সংস্কৃতিকে মান্য করে এসেছে।

তারা আরও বলেন—

  • পরিবারে নৈতিকতা
  • নারী-পুরুষের দায়িত্ব
  • বিবাহোত্তর অধিকার
  • উত্তরাধিকার ব্যবস্থার ন্যায়বিচার

এসব বিষয় কেবল আধুনিক আইন দিয়ে নয়, ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে সঠিকভাবে সমন্বয় করেই সমাধান করা সম্ভব।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় শরীয়াহ আইন: সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

সেমিনারের আলোচনায় উঠে আসে—বাংলাদেশে শরীয়াহ আইন পুরোপুরি প্রয়োগ করা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। কেউ কেউ এর পক্ষে, কেউ কেউ মনে করেন আধুনিক বাস্তবতায় একটি সমন্বিত কাঠামো আরও কার্যকর।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশের সংবিধান, সামাজিক কাঠামো, বিচারব্যবস্থা ও আধুনিক মানবাধিকার মানদণ্ড—সবকিছু বিবেচনায় রেখে ইসলামি আইন প্রয়োগ করতে হবে। বর্তমান মুসলিম পারিবারিক আইন মূলত শরীয়াহভিত্তিক, তবে আরও স্পষ্টতা এবং আধুনিকীকরণ প্রয়োজন।

ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার অপরিহার্য

বক্তারা ঐকমত্য পোষণ করেন যে, দেশের মানুষ বিশেষ করে যুব সমাজ যদি ইসলামের নীতি ও শরীয়াহ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা না রাখে, তবে পারিবারিক কলহ বাড়বে, সমাজে অস্থিরতা তৈরি হবে।

ধর্ম উপদেষ্টা বলেন,
“শিশু শ্রেণি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ইসলামের মৌলিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক না করলে সমাজে নৈতিকতার ঘাটতি পূরণ সম্ভব হবে না। ধর্মীয় জ্ঞানই মানুষকে সত্য, ন্যায় ও দায়িত্বশীলতার পথে চালিত করে।”

বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের ভূমিকা

বাংলাদেশ মসজিদ মিশন দীর্ঘদিন ধরে সমাজে ধর্মীয় জ্ঞান ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়ে কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিত সেমিনার, প্রশিক্ষণ, গবেষণা এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচি পরিচালনা করে।

এই সেমিনারটি দেশের চলমান সামাজিক বাস্তবতা ও ইসলামি পারিবারিক আইনকে আরও সুসংহত করার আলোচনা প্রজ্বলিত করেছে বলে উপস্থিতিরা মনে করেন।

ন্যায়পরায়ণ সমাজের জন্য জ্ঞানসমৃদ্ধ নেতৃত্ব প্রয়োজন

ধর্ম উপদেষ্টার বক্তব্যের সারমর্ম হলো—

  • ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন নেতৃত্ব ছাড়া শরীয়াহভিত্তিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়
  • আলেম-ওলামারা এখন দেশের উন্নয়নযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে সক্ষম
  • মুসলিম পারিবারিক আইনকে আধুনিক বাস্তবতার সঙ্গে সমন্বয় করে প্রয়োগ করতে হবে
  • পরিবার থেকে রাষ্ট্র—সব স্তরে নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা জরুরি

তিনি বলেন, দেশের মানুষ ন্যায়, শান্তি ও স্থিতিশীলতা চায়। সেই লক্ষ্য অর্জনে জ্ঞানসমৃদ্ধ নেতৃত্বই সবচেয়ে বড় শক্তি।

MAH – 13975 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button